সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান, চোপড়ার জেসিবি অথবা আড়িয়াদহের জয়ন্ত— পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক রাজনীতির বাস্তুতন্ত্রে এমন চরিত্রগুলি একই সঙ্গে যন্ত্র ও যন্ত্রী। রাজ্যের মনসবদারি ব্যবস্থায় খাজনা আদায় করার জন্য এই বাহুবলীদের প্রয়োজন— নিজের নিজের ভূখণ্ডে তারা একচ্ছত্র। সেই নির্বিকল্প ত্রাসের রাজত্বগুলি আবার প্রয়োজন রাজ্যের বৃহত্তর রাজনৈতিক যন্ত্রটিকে চালু রাখার জন্য। তৃণমূল কংগ্রেসের যে উত্তর-আদর্শবাদ জনবাদী রাজনীতি, তাতে দল এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য স্থানীয় স্তরে খাজনা আদায় করার অধিকার না-দিয়ে কোনও উপায় নেই। আর কোনও মন্ত্রেই দলের প্রতি বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করা অসম্ভব— বস্তুত, উত্তর-আদর্শবাদ রাজনীতি নিশ্চিত করেছে যে, ভিন্নতর কোনও মন্ত্র আদৌ নেই। ফলে, পশ্চিমবঙ্গে একটি কার্যত অভেদ্য দুষ্টচক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘চক্র’ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই ব্যবস্থায় আর কোনও ‘মাথা’ নেই, যেখান থেকে গোটা ব্যবস্থাটি পরিচালিত হতে পারে— দলের উচ্চতর নেতৃত্ব থেকে স্থানীয় বাহুবলী, সকলেরই অবস্থান এই চক্রের বিভিন্ন বিন্দুতে, যেখানে প্রত্যেকের অস্তিত্ব অপরের অস্তিত্বের উপরে নির্ভরশীল। এই চক্রের যে কোনও বিন্দুতে হস্তক্ষেপ করার অর্থ, গোটা চক্রটিই ভেঙে পড়া। কথাটি শীর্ষ নেতৃত্বও বিলক্ষণ জানে। অতএব, সর্ব স্তরেই দেখেও না-দেখার ভঙ্গিমাটি বজায় রাখা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। আড়িয়াদহের জয়ন্ত তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। সে এলাকার ক্লাবঘরে নিজস্ব ‘আদালত’ চালাত, দেখা যাচ্ছে সে কথাটি যেমন দলের উচ্চতর নেতৃত্ব বা পুলিশ-প্রশাসনের ‘অজানা’; তেমনই কী ভাবে সে রাতারাতি বেআইনি জমিতে অট্টালিকা গড়ে তুলল, কী ভাবে এক দরিদ্র দুধওয়ালা থেকে অতুল বৈভবের মালিক হয়ে উঠল, সে কথাও কেউ ‘জানে না’। প্রকৃত প্রস্তাবে, এই অজ্ঞানতা পশ্চিমবঙ্গের মনসবদারি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাধ্যতামূলক।
তবু, মাঝেমধ্যে ‘জানতে’ হয়— বিশেষত, এই স্মার্টফোন-নির্ভর সমাজমাধ্যমের যুগে। যখন জয়ন্ত বা জেসিবির মতো কোনও বাহুবলীর ভয়াবহ অত্যাচারের কথা প্রকাশ্যে আসে, তখন প্রাথমিক ভাবে অস্বীকারের ব্যর্থ চেষ্টার পর জানিয়ে দেওয়া হয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি দলের কেউ নয়; পুলিশকে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ করতে বলা হয়। এই ছকটি এতই বহুলব্যবহৃত যে, তাতে বিস্ময়ের তিলমাত্র অবকাশ নেই। ঘটনাবিশেষে পুলিশ খানিক ব্যবস্থা করেও বটে। কিন্তু, লক্ষণীয় যে, সেই ব্যবস্থা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধেই, মনসবদারি প্রথাটির বিরুদ্ধে নয়। এক জন শাহজাহান বা জয়ন্ত সরে গেলে তার জায়গা দ্রুত অন্য কেউ এসে পূরণ করে, ব্যবস্থাটিও চলতে থাকে। মনসবদারি ব্যবস্থাটির গুরুত্ব এমন খুচরো বাহুবলীদের চেয়ে ঢের বেশি— গোটা রাজ্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি পরিচালিত হয় যে ব্যবস্থায়, তার সঙ্গে কি কোনও মেজো-সেজো নেতা বা তাঁর পালিত গুন্ডার তুলনা চলতে পারে? কারও দুষ্কর্ম তার নিজস্ব ত্রাসের পরিধির বাইরে রাজ্যের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমক্ষে এলে সে তখন এই ব্যবস্থার পক্ষে বোঝা, ফলে তাকে দ্রুত ছেঁটে ফেলা গোটা দুষ্টচক্রটির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। পুকুর চুরি তো সামান্য ব্যাপার, যে পুলিশ-প্রশাসন এই মনসবদারদের ‘সাগর চুরি’ও দিব্য না-দেখে থাকতে পারে, সেই পুলিশই তখন সক্রিয় হয়ে তাকে ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে দেয়।
এই প্রগাঢ় অন্ধকারের মধ্যে অবশ্য একটি আলোর রেখাও আছে— রাজ্যের দুষ্টচক্র যদি ভাঙা সম্ভব হয়, তবে সে কাজের একমাত্র আয়ুধ লোকলজ্জা। যে কোনও অঞ্চলের মনসবদারি ব্যবস্থার অত্যাচারের ছবিটিকে গোটা রাজ্যের, গোটা দেশের সামনে প্রকট করে তোলা। বারংবার। শাসককে বারে বারে প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে বাধ্য করা। সুশাসনের শর্তগুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার রক্ষা করা যায় না, এ কথাটি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে থাকা, যত ক্ষণ না বোধোদয় হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy