Advertisement
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Women

ব্যর্থতার শিক্ষা

জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার ফল দেখাচ্ছে, সরকারি প্রকল্প নাবালিকা বিবাহ এবং অকালমাতৃত্ব রুখতে ব্যর্থ হয়েছে।

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২২ ০৫:০০
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গের বালিকাদের যে শ্রীহীন দশার পরিচয় মিলেছে জাতীয় সমীক্ষায়, তাতে সরকারি প্রকল্পের ‘কন্যাশ্রী’ ‘রূপশ্রী’ নামগুলি পরিহাস বলে মনে হতে পারে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার ফল দেখাচ্ছে, সরকারি প্রকল্প নাবালিকা বিবাহ এবং অকালমাতৃত্ব রুখতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০, এই পাঁচ বছরে বাল্যবিবাহ বেড়েছে দশটি জেলায়। সাতটি জেলায় ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের গর্ভধারণের হার বেড়েছে। আরও দেখা যাচ্ছে, পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, কলকাতার মতো অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ জেলাগুলিতেও বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে; উল্টো দিকে পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুরের মতো দরিদ্র জেলায় কমেছে। এই প্রবণতা ইঙ্গিত করছে যে, পরিবারের অভাবই নাবালিকা সন্তানের বিবাহের প্রধান কারণ, এই ধারণায় গলদ ছিল। অথচ, এই অপরীক্ষিত ধারণার ভিত্তিতেই দু’টি বৃহৎ প্রকল্প চালু করে রাজ্য সরকার। আঠারো বছর বয়সি মেয়েরা অবিবাহিত, এবং কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত, এই দু’টি জিনিস দেখাতে পারলেই কন্যাশ্রী প্রকল্পে তাদের পঁচিশ হাজার টাকা দেওয়া হয়।২০১৩-১৪ সালে শুরু হয় এই প্রকল্প, ২০১৯-২০ পর্যন্ত এতে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। ২০১৮ সালে রূপশ্রী প্রকল্প বছরে পনেরোশো কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে শুরু হয়েছিল, দুঃস্থ পরিবারগুলিকে অষ্টাদশ-উত্তীর্ণ মেয়ের বিয়ের অনুদান দিয়ে। দু’টি প্রকল্পই যে লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তার অর্থ, হয় প্রকল্পের বাইরে রয়ে গিয়েছে বহু পরিবার, অথবা অনুদানের টাকা নিয়েও তারা অকালে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। ফলে সারা ভারতে যখন নাবালিকা বিবাহের হার কমে দাঁড়িয়েছে তেইশ শতাংশে, তখন পশ্চিমবঙ্গে তা একচল্লিশ শতাংশ। বিহারেও কমেছে নাবালিকা বিবাহের হার, পশ্চিমবঙ্গে তা অনড়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেছেন, তাঁরা প্রকল্পগুলি নিয়ে আরও প্রচার করবেন। প্রচার কি যথেষ্ট হয়নি? কন্যাশ্রীর বিজ্ঞাপনে ঢেকে গিয়েছে সত্যের মুখ। সেই সত্য এই যে, উন্নয়নের যে কোনও পরিকল্পনায়, বিশেষত যেখানে মানুষের অভ্যাস ও আচরণ বদলানোর প্রয়োজন পড়ে, সেখানে আগে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের প্রয়োজন— যাকে বলা হয় পাইলট প্রজেক্ট। ছোট মাপের পরীক্ষা সফল হলে, তবে ধাপে ধাপে সারা রাজ্যে তার বিস্তার করা দরকার। সেই সঙ্গে নিয়ত মূল্যায়নের প্রয়োজন। কিন্তু এ পোড়া দেশে ভোটে যিনি জেতেন, তিনি কেবল সর্বশক্তিমান নয়, সর্বজ্ঞানী বলেও প্রতিপন্ন হন। তাই এক-একটি প্রকল্প ঘোষণা হয়ে যায়। সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন হয় না।

মেয়েদের জীবনে পরিবর্তন আনতে এই দুই প্রকল্পের ব্যর্থতা আরও একটি সত্য দেখিয়ে দেয়। তা হল— কেবল সূচকে পরিবর্তন চাইলেই হয় না, সমাজে পরিবর্তন চাইতে হবে। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী মেয়েদের জীবনের উপর তাদের আপন অধিকার প্রতিষ্ঠায় কিছুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি। বরং আঠারো বছর বয়স হলেই মেয়েদের বিয়েতে পরিবারের ‘অধিকার’-কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কন্যাশ্রী-প্রাপক যে মেয়েরা আঠারো বছর উত্তীর্ণ করে বিয়ে করেছে, তাদেরকেও কি প্রকল্পের ‘সাফল্য’ বলে ধরা চলে? ওই মেয়েরা আঠারো বছর বয়সে বিয়েতে আগ্রহী ছিল কি না, জীবনসঙ্গীকে তারা নিজেরা পছন্দ করেছে কি না, এ প্রশ্নের কোনও স্থান নেই সরকারের কাছে। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী মেয়েদের বিয়ের খরচে ভর্তুকি জোগাচ্ছে কেবল। মেয়েদের প্রকৃত সক্ষমতার জন্য প্রয়োজন অন্য নীতি। আজ রাজ্যকে এ-ও স্বীকার করতে হবে যে, অকাতরে টাকা বিলি করাই সুশাসনের পরিচয় নয়, যথার্থ পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণই সরকারের কাজ। এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

Women Society India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy