বঙ্গবাসী যে প্রশ্নটির উত্তর হাতড়ে হয়রান, তা এই রকম: পান থেকে সুপারিটুকু খসার আগেই ঠিক কী ভেবে বারে বারে স্কুল বন্ধ করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার? সন্দেহ হয় যে, রাজ্য প্রশাসনের কাছে শিক্ষা বর্তমানে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন একটি বিষয়। স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের নিশ্চয় রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে— সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম বলছে যে, তার অর্থনৈতিক গুরুত্বও নেহাত কম নয়; প্যারা টিচার ইত্যাদি নিয়োগের মাধ্যমেও কিছু অনুগতের কর্মসংস্থান হয় নিশ্চয়, ফলে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া শিখছে কি না, সেই ‘শিক্ষা’ তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কানাকড়িও কাজে লাগছে কি না, এই প্রশ্নগুলির কোনও অর্থ প্রশাসনের কাছে নেই। রাজ্যের বহু স্কুলের অপ্রতুল পরিকাঠামো, ছাত্রের অনুপাতে নিতান্ত কম শিক্ষকসংখ্যা, সেই শিক্ষকদেরও পাঠকক্ষের বাইরে যাবতীয় প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করা জাতীয় বাধাকেও তাৎপর্যহীন করে এখন স্কুল বন্ধ করে দেওয়াই দস্তুর হয়েছে।
স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার কুফল সম্বন্ধে রাজ্য প্রশাসন অবগত নয়, এমন দাবি করার উপায় নেই। এ বছরের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে সাদা খাতা জমা দেওয়ার বহর, ক্রমাগত স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীর খবর প্রকাশিত হওয়া, শিক্ষা সমীক্ষার ফল— সবই বলছে যে, কোভিডের কারণে দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। অনলাইন শিক্ষা বহু ছাত্রছাত্রীরই নাগালের বাইরে থেকে গিয়েছে, ফলে তারা এত দিনের বহু কষ্টে অর্জিত বিদ্যা বিস্মৃত হয়েছে অনভ্যাসে। স্কুল বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিক অসাম্যের বিভাজনটি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকটতর হয়েছে— দরিদ্রতর, শিক্ষার সুযোগহীন পিতামাতার সন্তানরা বাধ্য হচ্ছে পিছিয়ে পড়তে। অর্থনৈতিক অসাম্য যেন শিশুর শিক্ষায় প্রভাব ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিত করা যে কোনও কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রধানতম কর্তব্য। অতিমারির কারণে দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থেই অপূরণীয়। কিন্তু, তার পরও চেষ্টা করা উচিত ছিল যতখানি সম্ভব ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়ার। তার জন্য প্রয়োজনে বছরে ৩৬৫ দিন স্কুল খোলা রাখার কথা বলতে পারত সরকার। যে ভাবেই হোক, ছেলেমেয়েদের ফের লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারত। তার বদলে যে কোনও ছুতোনাতায় স্কুল বন্ধ করে রাখার একমাত্র ব্যাখ্যা— সরকারের কাছে শিক্ষা গুরুত্বহীন।
এই গুরুত্বহীনতার কারণ সন্ধান করলে উত্তর মিলবে, শাসকরা মনে করেন যে, স্কুল খোলা-বন্ধে ভোটের বাক্সে প্রভাব পড়ে না। যাঁদের কাছে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা সরকারি ব্যবস্থার মুখাপেক্ষী নন। এমনকি, সরকার যদি বেসরকারি স্কুলগুলোকেও বন্ধ রাখতে বাধ্য করে, তবুও তাঁদের সন্তানের লেখাপড়া আটকাবে না। আর, যাঁদের সত্যিই সরকারি ব্যবস্থা বই গতি নেই, তাঁদের মন জেতার জন্য রয়েছে হরেক ‘শ্রী’, ‘সাথী’, ‘ভান্ডার’। এমন বণ্টনমুখী প্রকল্প দরিদ্র মানুষের বিবেচনায় শিক্ষার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে কী ভাবে, সে কথা ভাবলে একটি সত্যের সম্মুখীন হতে হয়— শিল্পহীন এই রাজ্যে অধিকাংশ মানুষের জীবনেই (স্কুল)শিক্ষা কোনও অর্থকরী সম্ভাবনা বহন করে না। স্কুলে শিক্ষা অর্জন করলে তা জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ আর্থিক গতিশীলতা আনতে পারে, রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ সম্ভবত এই কথাটি আর বিশ্বাস করেন না— তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সেই বিশ্বাসের পথে বাধা হয় দাঁড়ায়। সম্ভবত এই কারণেই স্কুল বন্ধ থাকা নিয়ে বিরোধী রাজনীতি মূলত সমাজমাধ্যমের পরিসরেই সীমাবদ্ধ। ঘটনা হল, বাজার অর্থনীতি বেশ কিছু নতুন কাজ সৃষ্টি করেছে, স্কুলস্তরের শিক্ষাই যে কাজ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু, রাজ্যের যুব সম্প্রদায়ের সংখ্যার অনুপাতে তা নিতান্ত কম। শিল্প নেই বলেই শিক্ষা ক্রমে গুরুত্বহীন হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গবাসীকে এই কঠোর সত্যের সম্মুখীন হতে হবে। রাজ্য কোন পথে চলেছে, তা দেখে নিতে হবে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy