মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে আহত সিংহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাজ্য জুড়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে ভূতপূর্ব শিক্ষামন্ত্রী, সদ্য-প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সদ্য-প্রাক্তন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ায় এবং সেই গ্রেফতারির সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়ায় চতুর্দিকে যে নিন্দা, সমালোচনা ও অভিযোগের তুফান উঠেছে, গোটা শাসক দল এবং সরকারের উপর তার অনিবার্য অভিঘাত এসে পড়েছে, মুখ্যমন্ত্রীও তা থেকে অব্যাহতি পাননি, স্বাভাবিক ভাবেই। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সম্প্রতি ‘বঙ্গ-সম্মান’ প্রদানের মঞ্চ থেকে শোনা গিয়েছে তাঁর হুঙ্কার: “যে অন্যায় করেছে, তার বিরুদ্ধে আপনি যা পারেন করুন, আমার কিছু যায়-আসে না। কিন্তু আমার গায়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না।” চেষ্টা করলে কী হবে? মুখ্যমন্ত্রী উবাচ, “অযথা আমার গায়ে কালি ছেটানোর চেষ্টা করলে, মনে রাখবেন, আলকাতরা কিন্তু আমার হাতেও আছে।” শুধুই আলকাতরা? না, “আমি জানি, কী ভাবে লড়াই করতে হয়।” কী ভাবে? এখানেই তিনি নিক্ষেপ করেছেন সেই মোক্ষম উপমান: “আহত সিংহ কিন্তু ভয়ঙ্কর।”
মুখ্যমন্ত্রীর এমন উচ্চারণ সঙ্গত কি না, বিশেষত একটি সাংস্কৃতিক আয়োজনে অভ্যাগত অতিথিদের সমাবেশে দাঁড়িয়ে— সে-প্রশ্ন থাকুক। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরা এই সংস্কৃতিতেই অভ্যস্ত হয়েছেন। কিন্তু যিনি দলের সর্বময়ী নেত্রী এবং সরকারের অবিসংবাদিত কর্ত্রী হিসাবে চিরকাল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, নির্বাচনী প্রচারে রাজ্যের সমস্ত আসনে যিনি ‘আমিই প্রার্থী’ বলে ঘোষণা করে এসেছেন, দলীয় ও সরকারি অনুষ্ঠান যাঁর সচিত্র অনুপ্রেরণা ছাড়া ঘটতে পারে না, তিনি এমন বিপুল দুর্নীতি-কাণ্ডের নৈতিক দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন? তিনি কি জানেন না, মন্ত্রিসভার দায়িত্ব একক নয়, যৌথ। আইনের চোখে সেই দায় বিধানসভার কাছে, কিন্তু বিধায়করা জনসাধারণেরই প্রতিনিধি, সুতরাং বৃহত্তর নৈতিকতা অনুসারে সরকারের সমস্ত কর্মের (এবং অপকর্মের) জন্য মন্ত্রীরা জনসাধারণের কাছে সমবেত ভাবেই দায়বদ্ধ। বিশেষত, যিনি মন্ত্রিসভার মুখ্য, তিনি কী করেবলতে পারেন যে, সমস্ত ভাল কাজের কৃতিত্ব তাঁর (সরকারের), কিন্তু কে কী দুর্নীতি করেছে তার দায়িত্ব তিনি নেবেন না? রাজসিংহ আপন দায় অস্বীকার করে না। সে জানে, ক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্ব ওতপ্রোত থাকে।
শিক্ষক নিয়োগের গোটা ব্যবস্থাটি নিয়ে অকল্পনীয় দুর্নীতির যে সব অভিযোগ দীর্ঘ দিন ধরে উঠে এসেছে, আদালতকে যে ভাবে ক্রমাগত এই বিষয়ে কঠোর হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে, মন্ত্রী বিধায়ক আধিকারিকরা যে ভাবে এক পরিব্যাপ্ত অনাচারের জন্য অভিযুক্ত হয়ে আসছেন, তাতে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মুহূর্তে একটিই কথা বলবার ছিল: এই ঘটনাবলি গভীর উদ্বেগের কারণ, অপরাধীর শাস্তিবিধানে সমস্ত ভাবে চেষ্টা করা হবে, গোটা ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা হবে, আমরা তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। সেটাই হত রাজ্যের মুখ্য প্রশাসকের যোগ্য প্রত্যয়ী অবস্থান, যে অবস্থানের মধ্য দিয়ে তিনি সন্ত্রস্ত দলনেত্রীর ক্ষুদ্র ও সঙ্কীর্ণ ঘেরাটোপ থেকে নিজের উত্তরণ ঘটাতে পারতেন। অবশ্য সেই উত্তরণের তাগিদ থাকলে অনেক আগেই তিনি দুর্নীতি দমনে তৎপর হতে পারতেন। বঞ্চিত চাকরি-প্রার্থীরা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদীরা অনেক দিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অনাচারের অভিযোগ জানিয়ে আসছেন। সেই প্রতিবাদ দমনে রাজ্য সরকারের যত তৎপরতা দেখা গিয়েছে, তার সিকিভাগও যদি অন্যায়ের প্রতিকারে ব্যয় করা হত, মুখ্যমন্ত্রীর মাথা আজ অন্তত কিছুটা উঁচু থাকত। কিন্তু তা বুঝি হওয়ার নয়। গলা উঁচু রাখাটাই এখন শক্তিশালী নেতৃত্বের পরিচিত অভিজ্ঞান। হয়তো কর্তৃত্বের নিরাপদ রক্ষাকবচও বটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy