Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
BJP

হিন্দু নববর্ষ?

সৃষ্টিপর্বে যে উদার বহুত্ববাদী সমন্বয়ের ধর্ম, নববর্ষের সামাজিক বিবর্তনেও তাহারই পরম্পরা।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৫৫
Share: Save:

বিদ্যাসাগর মহোদয় তাঁহার ‘পাড়ার ছেলে’, সুতরাং দিলীপ ঘোষকে আটকাইবে কে? গরুর দুধ ছাঁকিয়া যিনি সোনা বাহির করিতে পারেন তিনি বাঙালির পঞ্জিকা সাঁতলাইয়া হিন্দু নববর্ষ বাহির করিবেন, তাহাতেই বা বিস্ময় কী? বাজে কথায় কান না দেওয়াই বিবেচনার কাজ, কিন্তু দিলীপ ঘোষ ব্যক্তিমাত্র নহেন, বিজেপির অধীশ্বররা তাঁহাকে দলের রাজ্য সভাপতির আসনে বসাইয়াছেন এবং তাঁহার সমস্ত উক্তি ও আচরণ সহ পরম সমাদরে লালন করিতেছেন— কে জানে গরল কিনা প্রকৃত পানীয়। অনুমান করা চলে যে, বৈশাখ পড়িবার পূর্বাহ্ণে বাঙালিকে হিন্দু নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাইবার উদ্যোগটি ঘোষবাবুর ব্যক্তিগত উদ্ভাবন নহে, ইহা তাঁহার দলের তথা সঙ্ঘ পরিবারের পরিকল্পিত আগ্রাসনের একটি হাতিয়ার। আক্ষরিক অর্থে ‘আগ্রাসন’, কারণ তাঁহারা বাংলা ও বাঙালির নববর্ষকে গ্রাস করিতে ব্যগ্র, সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করিতে পারিলে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি পরিতৃপ্ত হইবে, তাহার পাকযন্ত্র হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবে ‘হিন্দু নববর্ষ’ নামক বর্জ্য-পদার্থটি। আক্ষরিক অর্থেই বর্জ্য, কারণ বাঙালির সংস্কৃতিতে তাহার কোনও স্থান নাই।

বাঙালির সংস্কৃতি তাহার মৌলিক চরিত্রে মিশ্র, বহুমাত্রিক, বহুস্বর। তাহার নববর্ষ তথা বঙ্গাব্দ সেই মিশ্ররূপের এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা বঙ্গাব্দের সহিত বিক্রমাদিত্য শশাঙ্ক ইত্যাদি বিবিধ নাম জড়াইতে চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু সেই প্রকল্প হইতে পুরাণ, লোকবিশ্বাস ইত্যাদি ছাঁকিয়া লইলে যাহা অবশিষ্ট থাকে তাহা ইতিহাস নহে, প্রচারকদের আপন মনের মাধুরী— অমৃতই বিষ? বস্তুত, বঙ্গাব্দের ইতিবৃত্তে আগাগোড়া এক অসামান্য সম্মিলনের ঐতিহ্য রহিয়াছে। মোগল সম্রাট আকবরের উদ্যোগে কী ভাবে বৈশাখ হইতে সাল গণনার রীতিটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় তাহা আজ আর নূতন করিয়া ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু চান্দ্র বর্ষ ও সৌর বর্ষের হিসাব মিলাইয়া বঙ্গাব্দের ধারণায় যে ভাবে ইসলামি ইতিহাস গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হাত ধরিয়াছে, বাঙালির নূতন বছরের দিনটিতে হজরত মহম্মদের মদিনা যাত্রার স্মৃতি যে ভাবে নিহিত রহিয়াছে, তাহা এক কথায় রোমাঞ্চকর। ‘হিন্দু ভারত’ নামক হাওয়ার নাড়ু ফিরি করিবার বিষম দায় কাঁধে থাকিলে অবশ্য সেই রোমাঞ্চ উপলব্ধির বোধ বিনষ্ট হয়।

সৃষ্টিপর্বে যে উদার বহুত্ববাদী সমন্বয়ের ধর্ম, নববর্ষের সামাজিক বিবর্তনেও তাহারই পরম্পরা। সেই পরম্পরার দুইটি অধ্যায় বিশেষ প্রাসঙ্গিক: রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথ নববর্ষের ধারণাকে যে দার্শনিক মহিমায় ঋদ্ধ করিয়াছিলেন তাহার পরিচয় রহিয়াছে তাঁহার বিভিন্ন ভাষণে, প্রবন্ধে, কবিতায়। কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে শান্তিনিকেতনে উৎসবের মধ্য দিয়া নববর্ষ উদ্‌যাপনের ঐতিহ্যটিও ক্রমশ বিকশিত হইয়াছে। সেই উৎসবের সহিত কোনও ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ ‘হিন্দুত্ব’-এর সংযোগ নাই, থাকিতে পারে না। হিন্দু নববর্ষের কথা শুনিলে রবীন্দ্রনাথ নির্ঘাত বলিতেন: রাম রাম! অন্য দিকে, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে জন্ম লইবার পূর্ব হইতেই সেখানকার সমাজে নববর্ষ ছিল এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আত্মমর্যাদার সহিত সেই উৎসব ওতপ্রোত হইয়া গিয়াছিল। স্বাধীনতার পরে সেই ধারা উত্তরোত্তর বেগবান হইয়াছে। নববর্ষ বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান জাতীয় উৎসব। লক্ষণীয় ইহাই যে, পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসবের প্রসারে বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত ও প্রেরণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রধানত পরিবার বা স্থানীয় সমাজের পরিসর হইতে, ‘হালখাতা’র বাণিজ্যিক চালচিত্র হইতে নববর্ষ যে পশ্চিমবঙ্গেও ক্রমে এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হইয়াছে, তাহাকে একাত্তরের উত্তরাধিকার বলিলে হয়তো বিশেষ অত্যুক্তি হয় না। অতএব, বাঙালি বলিতেই পারে: হিন্দু নববর্ষ বানাইবার চেষ্টা করিবেন না, রাম গড়িতে হনুমান হইবে।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Dilip Ghosh Facebook Bengali New Year
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy