দেশের মানুষের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে সরকার যে সব আইন-বিধি তৈরি করে, সেগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য সরকারের মুখরক্ষা— এমন আশঙ্কা বার বার দেখা দিয়েছে। তা ফের গাঢ় হল সিলিকোসিস আক্রান্তদের সুরক্ষায় সরকারি নীতির কার্যকারিতা দেখে। সাংবাদিকের প্রতিবেদনে স্পষ্ট, এই বিধি যতখানি সরকারের আত্মসন্তুষ্টির কারণ, ততখানি শ্রমিকের আশ্বাসের কারণ হয়ে ওঠেনি। সিলিকোসিস আক্রান্তদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরিবারগুলি বিপুল ঋণগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে ক্ষতিপূরণের টাকা অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং ওষুধের দাম মেটাতেই শেষ হচ্ছে। পাথর খাদানের শ্রমিকদের নিয়মিত পরীক্ষা, রোগনির্ণয়ের বিধি রয়েছে— কিন্তু তার ব্যবস্থা তৈরি হয়নি, হওয়ার আশাও নেই। কারণ, অধিকাংশ পাথর খাদান ও পাথরগুঁড়োর কারখানা অবৈধ, সেখানকার শ্রমিকদের নথিভুক্তিই হয় না, ফলে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায়ও নেই। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিধি কতটা পালিত হচ্ছে, শ্রমিকদের মধ্যে সুরক্ষা সরঞ্জাম বিতরণ হচ্ছে কি না, সাংবাদিকের এ প্রশ্ন শুনে শ্রমিকরা হেসেছেন। তাঁদের কাছে এমন প্রশ্ন নিষ্ঠুর পরিহাস বলে মনে হতে পারে। রাজ্যের পাথর খাদানগুলি কার্যত মৃত্যুর বিচরণভূমি। পাথরগুঁড়ো ফুসফুসে প্রবেশ করবে, ওই গুঁড়ো থেকে ‘সিলিকা’ যৌগ ফুসফুসের কোষকে আক্রমণ করে ‘সিলিকোসিস’ রোগ তৈরি হবে, শ্রমিক কর্মক্ষমতা হারাবেন, শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে করতে এগিয়ে যাবেন মৃত্যুর দিকে— এই পরিণতিকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিয়েছে রাজ্য। যে সব এলাকা থেকে অতি দরিদ্র, কর্মহীন মানুষ যাচ্ছেন পাথর খাদানে কাজ করতে, সেখানকার গ্রামগুলিতে সিলিকোসিসে মৃত্যু কার্যত মহামারির আকার নিয়েছে।
সিলিকোসিস সঙ্কটের নিজস্ব গুরুত্ব কম নয়— আদালত থেকে মানবাধিকার কমিশন, সর্বত্র এর প্রতিকার, প্রতিরোধের জন্য আবেদন করেছেন শ্রমিক পরিবার ও সমাজকর্মীরা। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে সরকারি নীতি তৈরি হল বটে, কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর, শ্রম দফতর বা জেলা প্রশাসন তাকে বাস্তবে পরিণত করার উদ্যোগ করেনি। এটা আশ্চর্য নয়, কারণ শ্রমিক সুরক্ষা ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার আইনি ক্ষমতা বিভিন্ন সরকারি দফতরের ইতিপূর্বেই ছিল, নয়া নীতির জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন ছিল না। অতএব সিলিকোসিস সঙ্কটের গুরুত্ব এখানেও যে, তা এ রাজ্যের এক বৃহত্তর সঙ্কটের ইঙ্গিতবাহী। সেই সঙ্কট হল অবৈধ কর্মস্থলে নিযুক্ত শ্রমিকদের সুরক্ষাহীনতা। ভারতে সর্বত্রই অসংগঠিত ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যায় নিয়োগ হয়, তাই শ্রমিকের অধিকারের সুরক্ষা কঠিন।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এক বাড়তি সমস্যা রয়েছে। এ রাজ্যে অবৈধ কর্মক্ষেত্রগুলির সঙ্গে রাজনীতির বড়ই ঘনিষ্ঠতা। ইটভাটা, ভেড়ি নদীর স্বাভাবিক পথ রোধ করছে, চাষের জমি গ্রাস করছে। বালি খাদান, পাথর খাদান, প্রাকৃতিক সম্পদ অবাধে আহরণ করছে। এগুলির মালিকরা যেন পরিবেশ বিধি লঙ্ঘন করার, প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করার নিঃশর্ত ছাড়পত্র পেয়েছেন। পুলিশ-প্রশাসনের প্রশ্রয় ব্যতীত এত বিপুল হারে, এত দীর্ঘ দিন, এমন তস্করবৃত্তি চলতে পারে না। যে সব নিয়োগক্ষেত্রে দেশের আইন-বিধির প্রবেশ নিষেধ, সেখানে শ্রমিক স্বার্থসুরক্ষার নতুন নতুন বিধি কতটুকু কাজ দেবে? সিলিকোসিস সঙ্কট এ রাজ্যের সব অসংগঠিত ক্ষেত্রের সকল শ্রমিকের বিপন্নতার মৌলিক কারণটি তুলে ধরল। তা এই যে, কর্মক্ষেত্রের নিয়মিত পরিদর্শন, তার বিধিবদ্ধতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার কাজটি সরকার করছে না। শ্রম দফতর, জেলা প্রশাসন, পুরসভা-পঞ্চায়েতের আধিকারিকরা যত দিন খনি-খাদান, ভাটা-ভেড়ি মালিকদের কাছে নতজানু হবেন, তত দিন শ্রমিক বাঁচার পথ খুঁজে পাবেন না। রুদ্ধ থাকবে ন্যায়ের পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy