বিলম্ব অধিক নহে, মাত্র বিয়াল্লিশ বৎসর। ১৯৭৯ সালে ভারতীয় সংসদ আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইনটি পাশ করিয়াছিল। তাহার অন্যতম নির্দেশ ছিল সকল পরিযায়ী শ্রমিকের নথিভুক্তি। নির্দেশটি কার্যকর হইবে ২০২১ সালের অগস্টে— সংসদে জানাইলেন কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব। কেন্দ্র যে তথ্য-কাঠামো (ডেটাবেস) তৈরি করিতেছে, তাহাতে এই বার শ্রমিক-সম্পর্কিত তথ্য ভরিতে হইবে রাজ্যগুলিকে। শ্রমিকরাও সরাসরি নিজেদের নথিভুক্তি করাইতে পারেন— নয়া শ্রমবিধি (২০২০) অনুসারে স্বনথিভুক্তির সুযোগ রহিয়াছে। তবে কি শেষ অবধি রাষ্ট্র পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘পূর্ণ নাগরিক’ রূপে স্বীকার করিবে? গত বৎসর অতিমারির শুরুতে কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের চূড়ান্ত দুর্ভোগ, প্রাণহানি ও আর্থিক বিপন্নতা দেখিয়াছে দেশ। তাহার জেরে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের নিকট বার বার জবাব তলব করিয়াছে, কেন বিলম্ব? সমালোচনায় সরব হইয়াছে বিরোধীপক্ষ এবং সংবাদমাধ্যমও। এই তাড়া না পড়িলে হয়তো এখনও আইনটি খাতায়-কলমেই থাকিয়া যাইত। যদিও পরিযায়ী শ্রমিকই দেশের শিল্প ও উৎপাদন ক্ষেত্রের মেরুদণ্ড। তাঁহাদের দৈহিক শক্তি ও কর্মদক্ষতা সকল উদ্যোগকে সচল রাখিতেছে। ১৯৭৯ সালের আইনটি তাঁহাদের মৌলিক প্রয়োজনগুলিই কেবল সুরক্ষিত করিয়াছিল। যথা, নথিভুক্ত হইলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ভারতের যে কোনও স্থলে ন্যায্য মজুরি, কাজের ক্ষেত্রে সুরক্ষা সরঞ্জাম, দুর্ঘটনা বিমা প্রভৃতি পাইবেন। ভিন্রাজ্যেও সমাজকল্যাণমূলক সকল সরকারি পরিষেবা তাঁহারা পাইবেন; যে কোনও সঙ্কটে ঠিকাদার এবং সরকারি শ্রম দফতর তাঁহাকে সহায়তা করিতে দায়বদ্ধ থাকিবে।
যথাসময়ে এমন আইন কার্যকর হইলে পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার ঝুঁকি কমিত। ২৮ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বরাবঁকীতে পথদুর্ঘটনায় ১৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু এক দীর্ঘ মৃত্যুমিছিলের অংশ। অথবা, হয়তো আইন থাকিলেও সুরক্ষা মিলিত না। পরিযায়ী শ্রমিকের নথিভুক্তির জন্য আইনের তর্জনীর প্রয়োজন নাই। পশ্চিমবঙ্গের অন্তত কুড়ি লক্ষ শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজ করিতে যান। রাজ্য সরকার একাধিক বার তাঁহাদের নথিভুক্তির উদ্যোগ করিয়াছে— আজ অবধি সেই তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয় নাই। পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যাবৃদ্ধিকে বিরোধী দলগুলি রাজ্যের কর্মসংস্থানে ব্যর্থতা প্রমাণের অস্ত্র করিবে, সম্ভবত এই আশঙ্কা কাজ করিয়াছে। নীতির দৃষ্টিতে অবশ্য এই মানসিকতা তামাদি হইয়াছে— দেশের মধ্যে পরিযায়ী শ্রম কমাইবার পরিবর্তে তাহাকে উৎসাহিত করিতে চায় নীতি আয়োগ।
এই বৎসরের গোড়ায় পরিযায়ী-সম্পর্কিত খসড়া নীতি প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতে নীতি আয়োগ পরিযায়ী শ্রমকে উন্নয়নের ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। তাহার কারণ, মূলত পরিযায়ী শ্রমের জোরেই দেশের অর্থনীতি কৃষি হইতে সরিয়া ক্রমশ শিল্প ও পরিষেবায় আসিতে পারিয়াছে। শ্রমিক কল্যাণের ধারণা সরাইয়া শ্রমিক অধিকারকে প্রাধান্য দিয়াছে আয়োগ। পরিযায়ী শ্রমকে দেশের সার্বিক শ্রমশক্তির সহিত সমন্বিত করা প্রয়োজন। পরিযায়ী শ্রমিককে খাদ্য নিরাপত্তা, সুরক্ষিত আবাস, দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রভৃতি জোগাইবার সুপারিশ করিয়াছে আয়োগ। কিন্তু কবে হইবে? চার দশক প্রাচীন একটি আইনের বিধান সদ্য রূপায়িত হইল। শ্রম বিধির অন্যান্য নির্দেশ— পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, টেলিফোন হেল্প লাইন— রূপায়ণ হইবে কবে, জানা নাই। শ্রমিকদের সুলভ আবাস এবং ভিন্রাজ্যে রেশন প্রাপ্তি এখনও পরিকল্পনার স্তরে। নানা রাজ্যের সরকার এবং কেন্দ্রের আধিকারিকদের মধ্যে সক্রিয়, নিবিড় সমন্বয় না থাকিলে এর কোনওটি বাস্তবে কার্যকর হইবে না। শ্রমিকের ভাগ্যে এতগুলি শিকা কি ছিঁড়িবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy