ফাইল চিত্র।
আনিস খানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সত্যান্বেষণে ‘বিশেষ তদন্তকারী দল’ গঠনের সিদ্ধান্তে আপাতত আদালতের অনুমোদন মিলিয়াছে, যদিও মৃতের পরিবারের সদস্যের উপস্থিতিতে এবং জেলা বিচারকের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয় বার ময়না তদন্তের নির্দেশটি তাৎপর্যপূর্ণ। তাৎপর্যপূর্ণ তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে দুই সপ্তাহে আদালতে রিপোর্ট দাখিল করিবার অনুজ্ঞাও। যে পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশ, তাহাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলিলে কম বলা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারির রাত্রির ভয়ঙ্কর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে যে গভীর সন্দেহের সৃষ্টি হয়, ইতিমধ্যে একাধিক পুলিশকর্মীর ‘প্রাথমিক শাস্তি’ এবং থানার দারোগাকে ‘অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটিতে পাঠাইবার’ পদক্ষেপে তাহা গভীরতর হইয়াছে। প্রসঙ্গত, বামফ্রন্ট সরকার যখন পুলিশের অপকীর্তির তদন্তের ভার পুলিশের গোয়েন্দাদের হাতে তুলিয়া দেয়, তখন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী হিসাবে বলিয়াছিলেন, যাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাহারাই তদন্ত করিবে, ইহা কী করিয়া মানিয়া লওয়া যায়? আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং আস্থা জ্ঞাপনের পরে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা যাইতেই পারে: পনেরো বৎসর আগে যে যুক্তি সত্য ছিল, আজও কি তাহা সমান সত্য নহে?
এই সত্যটি জানেন বলিয়াই কি মুখ্যমন্ত্রী ‘সিট’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্ত’ হইবার আশ্বাস দিয়াছেন? তদন্ত যে অন্য প্রকার হইতে পারে, মনের সেই আশঙ্কাটিই কি তবে তাঁহার উচ্চারণে বাহির হইয়া পড়িল? তাঁহার এই আশ্বাসের সূত্র ধরিয়াই গূঢ়তর একটি সমস্যার প্রসঙ্গও আসে। তদন্ত নিরপেক্ষ না থাকিলে তদন্তের কোনও অর্থই থাকে না, অথচ নিরপেক্ষ তদন্ত বস্তুটিই উত্তরোত্তর দুর্লভ হইয়া পড়িয়াছে। আনিস খান সংক্রান্ত তদন্তের ভার সিবিআইকে দিবার প্রস্তাব শুনা যাইতেছে, তাঁহার পরিবার হইতেও সেই দাবি উঠিয়াছে, যে দাবি আবারও বামফ্রন্ট আমলে বিরোধী নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিবিআই তদন্ত চাহিবার ইতিহাস স্মরণ করাইয়া দেয়। কিন্তু সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা লইয়াও সংশয় বিস্তর। বাকি থাকে বিচারবিভাগীয় তদন্ত। তাহার অভিজ্ঞতাও অনেক সময়েই আশাপ্রদ নহে, বিশেষত অনেক সময়েই তদন্তের গতি অতিমাত্রায় দীর্ঘায়িত হইয়া থাকে। আরও বড় প্রশ্ন— অপরাধের তদন্ত করিবার ভার ক্রমাগত অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইবে কোন যুক্তিতে? প্রশাসনের কাজ তো প্রশাসনই করিবে?
এইখানেই সমস্যার মূল। প্রশাসন নিরপেক্ষ না হইলে তদন্ত নিরপেক্ষ হয় না। রাজ্যের পুলিশ হউক, অথবা কেন্দ্রের সিবিআই, উভয়ের ক্ষেত্রেই বিশ্বাসযোগ্যতার বিপুল অভাবের মূলে রহিয়াছে প্রশাসনের আচরণে নিরপেক্ষতার ঘাটতি। যাহারা যেখানে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তাহারা সেখানে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া তদন্তকে প্রভাবিত করিবে— এমন আশঙ্কা কার্যত অবধারিত হইয়া উঠিয়াছে। রাজ্যের পুলিশ ‘দলদাস’ বলিয়া খ্যাত, সিবিআইয়ের নাম ‘তোতাপাখি’। এই নামগুলি কতখানি বাস্তবানুগ তাহা লইয়া তর্ক থাকিতে পারে, কিন্তু অগ্নি ব্যতীত ধূম হয় না, কারণ না থাকিলে এমন নামাবলিও সৃষ্ট হয় না। রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন বামফ্রন্ট জমানাতেই দীর্ঘকাল দলতন্ত্রের বশীভূত থাকিয়া নিরপেক্ষতার কক্ষ হইতে চ্যুত হইয়াছিল। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসিবার পরে সেই ঐতিহ্যের অবসান ঘটে নাই, বরং সন্দেহ হয় যে পক্ষপাতের মাত্রা বাড়িয়া গিয়াছে, পক্ষপাতের রূপটি আরও প্রকাশ্য হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং, পুলিশ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্ত’ করিবে, এমন আশ্বাসে নাগরিক যথেষ্ট ভরসা রাখিতে না পারিলে শাসকদের রাগ হইতে পারে, কিন্তু নাগরিক নাচার। আপাতত ভরসা বলিতে আদালতের নির্দেশ ও নজরদারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy