বইয়ে মগ্ন এক বইপ্রেমী। ছবি পিটিআই।
বই ও পাঠকের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়, কিন্তু শোনা যায় না একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ: বই ও ছাড়ের মধ্যে সম্পর্কটি কেমন? অথচ প্রসঙ্গটি পাঠ ও পাঠকের সঙ্গে অতি নিবিড় ভাবে যুক্ত। বাঙালি পাঠক, বিশেষত কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলার গ্রন্থপ্রেমী ও পাঠকেরা বলবেন, বই ও ছাড়ের সম্পর্ক অম্লমধুর। সারা বছর বইপাড়ায় মোটামুটি কুড়ি শতাংশ ছাড় তাঁরা পেয়ে আসছেন, বইপাড়ায় প্রকাশক বা বিক্রেতার সঙ্গে পাঠক-ক্রেতার সম্পর্কটি এখনও অনানুষ্ঠানিক ও আন্তরিক। পুঁজিবাদের এই রমরমার কালেও বই এখনও পর্যন্ত নিছক ‘পণ্য’ হয়ে ওঠেনি, সেই আশ্চর্য বিষয়টিই প্রতিফলিত হয় বছরভর বাংলা বইয়ের বিকিকিনিতে। সমাজমাধ্যম এসে যেন এই সম্পর্ককে বহুস্তরীয় বিস্তার দিয়েছে— বহু প্রকাশক ও বই-বিক্রেতা প্রকাশিতব্য বা নতুন বইটির বিক্রি বাড়াতে সমাজমাধ্যমের সাহায্য নিচ্ছেন, ‘প্রিবুকিং’-এ বিশেষ ছাড় ঘোষণা করে বইয়ের প্রতি পাঠকের এক ধরনের চাহিদা বা আকর্ষণ তৈরি করছেন। তাতে সব দিকই বজায় থাকছে: পাঠকও ছাড় পেয়ে খুশি, প্রকাশক বা বিক্রেতার ব্যবসাতেও লাভ থাকছে, বইয়ের কাটতিতে তৃপ্ত হচ্ছেন লেখকও।
বইমেলা আবহে ছবিটি একটু অন্য রকম, আনুষ্ঠানিক ভাবে মেলায় বেঁধে দেওয়া ছাড় ১০ শতাংশ মাত্র। এমনই চলে আসছিল সম্প্রতি, তবে তার মধ্যেও ছিল নানা ব্যতিক্রম: ছোট-বড় নানা স্টলে প্রকাশক ও বিক্রেতা, লিটল ম্যাগাজ়িন প্যাভিলিয়নে ছোট পত্রিকা-কর্তৃপক্ষ, পাঠকের ‘আবদার’ রক্ষায় বেশি ছাড় দিয়ে আসছিলেন। সমাজমাধ্যমে আজকাল বইকেন্দ্রিক নানা গোষ্ঠী বা ‘গ্রুপ’, তাদের ‘সদস্য’সংখ্যাও বিপুল, সেই সদস্যপদের প্রমাণ দেখালে কিছু স্টলে বেশি ছাড়ের সুযোগও পাওয়া যাচ্ছিল ইদানীং। তবে এ বছর বইমেলা শুরুর অব্যবহিত আগে জানা গেল, মেলার উদ্যোক্তার তরফে বইমেলায় ছাড় ১০ শতাংশেই স্থিত করার ‘নির্দেশ’। সমাজমাধ্যমে বই-গোষ্ঠীগুলিতে পড়ল আলোড়ন— বইপ্রেমীদের সকলের আর্থিক সংস্থান সমান নয়, মেলায় কিছু বেশি ছাড় পেলে বেশি বই কেনার প্রণোদনা পাওয়া যেত, বেশি বই বিক্রি মানে আখেরে মেলা আয়োজকদেরই মুখ উজ্জ্বল হওয়া, ইত্যাদি। কম ছাড়ে মেলাকে বেঁধে দিলে আসলে বাংলা বইয়ের বিক্রিই ব্যাহত হবে, এমন মন্তব্য ও অনুযোগও শোনা গেল।
সত্য সে যে সুজটিল। সব যুক্তিরই প্রতিযুক্তি আছে। তাই এ কথাও শোনা গেল, বইয়ে ছাড় দিলে আসলে পাঠকেরই ক্ষতি, কারণ বহু প্রকাশক বইয়ের দাম মুদ্রণ-খরচের তুলনায় বহুলাংশে বাড়িয়ে রাখেন এবং অতঃপর পাঠককে বেশি ছাড় দেন। তাতে তুল্যমূল্য বিচারে প্রকাশক-পরিবেশক-বিক্রেতার কাছেই লাভের গুড় জমে বেশি; ক্রেতা মনে করেন তিনি বেশি ছাড়ে এবং কম দামে বই পাচ্ছেন, প্রকৃত অর্থে বইটির যে বাজারদর হওয়া উচিত তার থেকে বেশি দামে তিনি বই কিনছেন— ছাড়ের পরেও এ কথা সত্যি। তাঁদের মত এই যে, এর থেকে অনেক ভাল হত বইয়ে কোনও ছাড় না থাকলে, ‘ছাড়-সংস্কৃতি’র অবর্তমানে সামগ্রিক ভাবে বইয়ের দাম নিচু তারে বেঁধে রাখা সম্ভব হত। বাংলা বই-বাজারে এমন প্রকাশকও আছেন যাঁরা ছাড়ে বিশ্বাস করেন না, ছাড় দেন না, বইয়ের বিক্রয়মূল্যই কম ধার্য করেন। কিন্তু তাঁরা বিরল ব্যতিক্রম, এবং তাঁদের প্রতিবাদী উপস্থিতি আসলে বাজারচলতি বই-ছাড়ের প্রকট প্রবণতাটিই তুলে ধরে। বাঙালি পাঠক-ক্রেতা সম্পর্কে এই ধারণাটিও চালু যে ইংরেজি বই বেশি দামে কিনতে তাঁরা দ্বিধা করেন না, কিন্তু বাংলা বইয়ের দাম বেশি দেখলে ভুরু কোঁচকান। বাংলা বইয়ের বিকিকিনির নেপথ্যে এ-হেন বিস্তর প্রশ্ন, এখনও পর্যন্ত তাদের অধিকাংশেরই উত্তর নেই— পাঠকসমক্ষে তাদের নিয়ে আলোচনাও হয় না বললেই চলে। অথচ প্রশ্নগুলি ওঠা প্রয়োজন, বাংলা বইয়ের ভবিষ্যতের খাতিরেই। বইমেলা ক্রমে পশ্চিমপানে ঢলেছে, সেই মঞ্চেই এই আলোচনা হতে পারত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy