ফাইল চিত্র।
গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবনে শ্রীলঙ্কার অগণন নাগরিকের অবাধ বিচরণ, বিশ্রাম ও বিনোদনের চিত্রাবলি গার্সিয়া মার্কেস-এর দি অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক কাহিনির প্রথম দৃশ্যটি মনে পড়িয়ে দেয়— অতিকায় সিংদরজায় ‘কেবল একটি ঠেলা দেওয়ার দরকার ছিল’। দক্ষিণ আমেরিকার সেই নামহীন স্বৈরতন্ত্রের পরিণতির সঙ্গে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির ফারাক বিস্তর, কিন্তু শাসক এবং শাসিতের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধানের ছবি দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপভূমিতে প্রকট হয়ে উঠল, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য দেশ বা কালের গণ্ডিতে সীমিত নয়। বিশ্বের ইতিহাসে এবং গল্পে উপন্যাসে শিল্পকৃতিতে নাটকে সিনেমায় অনেক বার দেখা জনজাগরণের এই দৃশ্য জানিয়ে দিল, জনসমর্থন পেলেই হয় না, তাকে ধরে রাখতে হয়। তা না হলে, অতি বড় শক্তিমান শাসকের গদিও টলমল করতে পারে।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে মহাশক্তিমান হিসাবে খ্যাত হয়েছিলেন। সেই খ্যাতির পিছনে ছিল দেশের উত্তরাঞ্চলে তামিল প্রতিরোধ ধ্বংস করতে তাঁর দাদা, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সেনাপতির ভূমিকায় গোতাবায়ার নির্মম অভিযান, যে অভিযান তার ভয়াবহ অমানবিকতার কারণে দুনিয়া জুড়ে নিন্দিত হয়, কিন্তু সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধ সমাজের বিপুল সমর্থন পায়। ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর জয়ের পিছনে এই ইতিহাসের বড় অবদান ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয় সেই বছরের এপ্রিলে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হানার ঘটনা— দেশের মানুষ সন্ত্রাস দমনের জন্য শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট চেয়েছিলেন। তিন বছরের মধ্যে অজস্র জনকণ্ঠে ‘ভাগো গোতা, ভাগো’ ধ্বনির তাড়নায় তাঁকে যে উল্টোরথে চড়ে পালাতে হয়েছে, তার কারণ, চূড়ান্ত আর্থিক বিপর্যয়, বুকের ছাতি, বাহুর পেশি বা বোমারু বিমান দিয়ে যে বিপর্যয় রোধ করা যায় না।
বিপর্যয়ের কিছুটা শিবকীর্তি বটে, কিন্তু নিজকীর্তিই প্রধান। সন্ত্রাসী হানা এবং অতিমারির উপর্যুপরি প্রকোপ পর্যটন শিল্পে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছে, যে শিল্পটি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলেও খাদ্য এবং জ্বালানির জোগানে টান পড়েছে, দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু বহিরাগত বিপদের মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় বিচক্ষণতা ও সৎসাহসের পরিচয় দেখাননি মহাশক্তিমান গোতাবায়া, উল্টে নির্বুদ্ধিতা ও গোঁয়ার্তুমির মারাত্মক মিশেল দিয়ে একের পর এক আত্মঘাতী গোল দিয়েছেন। খাদ্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো যখন অত্যন্ত জরুরি ছিল, তখন রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। খাদ্যের ফলন বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। অতিমারি-বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখে রাজকোষের ঘাটতি সামলানোর চেষ্টা না করে ‘বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে’ করের হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার ফলে সরকার এখন সম্পূর্ণ দেউলিয়া। আইএমএফ ঋণ কার্যত অপরিহার্য। সেই ঋণের উপর দাঁড়িয়ে এবং দ্রুত আর্থিক নীতির সংস্কার সাধন করে শ্রীলঙ্কা চরম সঙ্কট থেকে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক বিষয়ে এই দেশের সামর্থ্য ঘুরে দাঁড়ানোর বড় পাথেয় হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রথম কাজ অবিলম্বে একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রশাসন তৈরি করা। সুস্থিরতা অনেক সাধনার ব্যাপার, কিন্তু আগে অস্থিরতা দূর হোক। সর্বদলীয় সরকার গঠনের যে উদ্যোগ চলছে, তা এই লক্ষ্য পূরণের পথে জরুরি পদক্ষেপ, কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ। জনসাধারণের যথার্থ বিশ্বাস ও আস্থা ফিরে পেতে প্রয়োজন একটি সর্বদলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার, সমস্ত অঞ্চল, জাতি এবং বর্গের নাগরিকরা যার প্রকৃত অংশীদার হয়ে উঠবেন। অভূতপূর্ব সঙ্কট থেকেই অভাবিতপূর্ব সমাধানের উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিহাসে তার নজির আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy