মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যে খাদ্য-বাসস্থানের অভাব যখন প্রকট, তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন পুজোর আয়োজনের জন্য সরকারি অনুদান আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন, সে প্রশ্ন তুলে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে কলকাতা হাই কোর্টে। পাশাপাশি কর্মী সংগঠনগুলিও বকেয়া ডিএ-কে অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। কর্মী-অসন্তোষ রাস্তায় নেমে এলে, বা আদালত পুজোর অনুদানের উপর স্থগিতাদেশ দিলে তা শাসক দল তৃণমূলের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিকর হবে। কিন্তু এহ বাহ্য। আসল প্রশ্ন হল— যা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমোহিনী রাজনীতির ব্রহ্মাস্ত্র, তা কি এ বার বুমেরাং হয়ে তাঁকেই আঘাত করছে? বিনোদনের উন্মাদনার বাতাসে দলের পালে হাওয়া লাগে বটে, কিন্তু তার জোরে বেশি দূর যাওয়া কঠিন। বরং বিনোদনে প্রমত্ত করে রাখার চেষ্টা জনমানসে বিদ্রোহের উদ্রেক করে। তার নিদর্শন মেলে ইতিহাসে। জুলিয়াস সিজ়ার তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জয় করে একচ্ছত্র শাসক হওয়ার পর এক বিপুল বিনোদনের আয়োজন করেন, যেখানে চারশো সিংহ, দু’শো ঘোড়া, কুড়িটি হাতি এবং অগণিত সৈন্য লোক-দেখানো যুদ্ধে প্রাণ দেয়। এই অপব্যয়ে রোমের নাগরিকদের মধ্যে বিপুল অসন্তোষ দেখা দেয়, দাঙ্গা শুরু হয়, দুই নাগরিকের প্রাণদণ্ডে সে পর্বের সমাপ্তি ঘটে। রাজনীতির মঞ্চে এই ট্র্যাজেডির পুনরভিনয় আজও হচ্ছে। এ কথা সত্য যে, জনচিত্ত অতিশয় চঞ্চল। ভয়, লোভ, জাতিগর্বের উন্মাদনায় তা সহজেই আন্দোলিত হয়। সেই তরলতার সুযোগ নিয়ে জনসমর্থন আদায় করেনি, এমন শাসক ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবু এ-ও ঐতিহাসিক সত্য যে, সব উত্তেজনার শেষে সুপ্রশাসন, সুপরিচালিত অর্থব্যবস্থার খোঁজ পড়েছে। সন্ধান দিতে না পারলে সরে যেতে হয়েছে শাসককে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়েছে, যখন রাজ্যগুলিতে কোনও একটি দলের সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, তখন সেখানে দরিদ্রতম মানুষের অন্ন-আবাসের নিরাপত্তা জোগানোর কাজে উল্লেখযোগ্য কোনও সাফল্য রয়েছে।
মেলা-খেলা, পুজো-উৎসবের কাড়া-নাকাড়ার পিছনে খাদ্য-শিক্ষা-বাসস্থানের প্রশ্নগুলো নীরবে নিভৃতে থেকে যায়। তেমনই একটি প্রশ্ন— রাষ্ট্রের সম্পদে কার অগ্রাধিকার? এর উত্তর তৃণমূল সরকারের কাছে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, ন্যূনতম দরে ধান ক্রয় প্রভৃতি জনকল্যাণের প্রকল্প যে বহু দরিদ্রকে প্রতারণা করেছে, সে সত্য ক্রমশই নগ্ন হয়ে উঠছে। ক্লাবকে টাকা বিতরণ অছিলাও খোঁজেনি— এ হল টাকা দিয়ে শাসকের আনুগত্য কেনার নির্লজ্জ প্রয়াস।ইতিপূর্বে আদালতে সরকার বলেছে, পূজামণ্ডপে কোভিড-সুরক্ষার জন্য ওই অনুদান। কথাটা হাস্যকর। অসুরক্ষিত মণ্ডপ সরকারি অনুমোদন পাবে কেন? কেনই বা সরকার বিদ্যুতের খরচে ছাড় দেবে?
প্রশ্ন ওঠে নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়েও। সমাজকল্যাণে বাংলার নাগরিক সমাজের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। পরাধীন দেশে পাড়ার ক্লাব ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, নৈশস্কুল স্থাপনা থেকে মহামারিতে মৃতদেহ সৎকার, সব কাজ স্বেচ্ছায় বহন করেছে, কেবলমাত্র সংগঠনের শক্তিতে এবং জনকল্যাণের অনুপ্রেরণায়। আজ কেন সরকারি অনুদান অপরিহার্য মনে হচ্ছে? কোভিড-উত্তর দারিদ্রের দিকে চেয়েও কি অর্থহীন পুরস্কারের জন্য অশ্লীল হুড়োহুড়ি করবে বাংলার ক্লাবগুলি? মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে যে সংগঠন, সেখানে কখনও শক্তির আবাহন হতে পারে না। অপুষ্টি, অশিক্ষা, কর্মহীনতা, ক্রমবর্ধমান দারিদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাজকোষের এক পয়সাও অপব্যয়ের অধিকার নেই রাজ্য সরকারের। উন্নয়নের টাকায় পূজামণ্ডপের আলো জ্বললে লজ্জার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে বাংলায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy