Advertisement
১৫ অক্টোবর ২০২৪
Durga Puja 2024

অ-সাধারণ

মণ্ডপে মণ্ডপে আলোর অসাধারণ কাজ, ইট কাঠ লোহা শোলা মাটি বাঁশ কাপড়-সহ নানা মাধ্যমে তৈরি শিল্পসজ্জার অপূর্ব আবহ দেখে বোধ হচ্ছিল— প্রতি বারই যেমন হয়— এরা সত্য, সকলই সত্য।

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:৪৭
Share: Save:

কয়েকটি দিনের মিলনমেলা অবশেষে ভাঙল। গত প্রায় দিন দশ-এগারো দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে কলকাতা রাতারাতি হয়ে উঠেছিল এক আশ্চর্য প্রদর্শশালা, সেই প্রদর্শনীটি শেষ হল। প্রদর্শগুলি বিচিত্র, বহুবর্ণ, তাদের বাস্তবমুখিতা বিস্ফারিত চোখে দেখার মতো। মহানগরীর উত্তর থেকে দক্ষিণ নানা জায়গায় কোথাও চোখের সামনে দেখা দিয়েছে হোয়াইট হাউস, কোথাও বা তিরুপতি মন্দির। কোথাও উৎস থেকে মোহনাবধি বিস্তৃত গঙ্গার গোটা যাত্রাপথটাই চর্মচক্ষে দৃশ্যমান, কোথাও বারাণসীর গঙ্গার ঘাট জেগে উঠেছিল সন্ধ্যারতির ভাবগম্ভীর সমারোহ নিয়ে। কে বলবে এই সবই কৃত্রিম, নকল, সাময়িক? মণ্ডপে মণ্ডপে আলোর অসাধারণ কাজ, ইট কাঠ লোহা শোলা মাটি বাঁশ কাপড়-সহ নানা মাধ্যমে তৈরি শিল্পসজ্জার অপূর্ব আবহ দেখে বোধ হচ্ছিল— প্রতি বারই যেমন হয়— এরা সত্য, সকলই সত্য। প্রতি বছর দুর্গাপুজো ঘিরে বাঙালি এই মায়াময় বিভ্রমকে আপন করে নেয়, এ বারও তার ব্যত্যয় হয়নি কোনও।

কয়েক দিনের এই যে অন্য রকম বাঁচা, একে স্রেফ বিস্ময়কর এক শিল্প-অভিজ্ঞতা বলে ভাবাটা সত্য বটে, তবে সেটাই সব নয়। পুজো ঘিরে ক’দিনের এই ব্যতিক্রমী যাপনের তাৎপর্য বহুবিধ, বহুস্তরীও। দিন-রাত মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে ভিড় জমিয়েছেন যাঁরা, শহরতলি মফস্‌সল ও গ্রাম থেকে রোজ লোকাল ট্রেন-মেট্রোয় চেপে এসেছেন কলকাতায়, তাঁদের এক বৃহদংশের কাছে এ বিন্দুতে সিন্ধু দেখার শামিল। তা নইলে কেন বিভিন্ন মণ্ডপে কৃত্রিম ভাবে তৈরি গঙ্গা, বিশ্বনাথ বা জগন্নাথ মন্দির, কপিলমুনির আশ্রম দেখে এবং তা আগাগোড়া নকল জেনেও মানুষ জোড়হস্ত হয়ে প্রণত হবেন, মণ্ডপে রাখা দানবাক্স ভরিয়ে দেবেন প্রণামীতে! পুণ্যার্থী মানুষ যে মন নিয়ে বছরভর কালীঘাট দক্ষিণেশ্বর বা বেলুড় মঠ দর্শনে আসেন, সেই একই তীর্থযাত্রীসুলভ মন-মানসিকতা চোখে পড়ে দুর্গাপুজোর সময় শহরের মণ্ডপে মণ্ডপে। ধর্মবিশ্বাসের বাইরে বৌদ্ধিক চর্চার রসদ খোঁজেন যে মানুষেরা, এ বারের দুর্গাপুজোর পরিসর তাঁদেরও প্রতি অকৃপণ ছিল: কোথাও মণ্ডপে রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের জীবনকৃতির স্মরণ, কোথাও ফুটে উঠেছে কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন মূর্তি-কথা কিংবা বাংলার জামদানির ইতিহাস, আলপনা, পুতুল, সরাচিত্রের ঐতিহ্য।

যে যা চেয়েছেন, যেমন ভাবে চেয়েছেন, শারদোৎসব সেই সবই, সেই ভাবে অকাতরে উজাড় করে দিয়েছে। যিনি তীর্থ খুঁজেছেন, পেয়েছেন; যিনি দেখতে চেয়েছেন দূরপ্রদেশের দুর্গম মন্দির, নয়ন সার্থক করেছেন তা দেখে; যিনি চেয়েছেন বিস্মৃতপ্রায় গুণিজন, শিল্পকীর্তি বা সংস্কৃতিধারা দুর্গাপুজোর হাত ধরে ফের এক বার উঠে আসুক প্রচারের আলোয়, তিনিও বিফলমনোরথ হননি। এমনকি, রাজ্য-রাজনীতি ও সমাজমন তোলপাড় করা যে মর্মন্তুদ ঘটনাটির জেরে উদ্বিগ্ন ও প্রতিবাদী মানুষ দেখতে চেয়েছেন দুর্গাপুজোর পরিসরই এ বছর হয়ে উঠুক প্রতিবাদের উৎসবস্থল, সেই চাওয়াও সার্থক হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই— অনেক বাড়ির পুজোয়, আবাসনে এমনকি কিছু বারোয়ারি পুজোমণ্ডপেও দেখা গিয়েছে ন্যায়বিচারের দাবি— নানা রূপে। এই সব নিয়েই এ বারের শারদোৎসবের মনন-চালচিত্রটি আঁকা হয়েছে: একই সঙ্গে বৈভবে ও বিরাগে, বাহুল্যে ও অনৈশ্বর্যে। পারস্পরিক বৈপরীত্যের এই সহাবস্থানই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উদ্‌যাপনকে করে তুলেছে অ-সাধারণ, বললে ভুল হবে না মোটেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE