আর্থিক সঙ্কট প্রবল, কোষাগার ঠেকেছে তলানিতে। তাই কলকাতা পুরসভার পেনশন বিভাগে নোটিস পড়েছে, গত ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগসুবিধা আপাতত বন্ধ। ‘আপাতত’ বলা হলেও তা রীতিমতো আশঙ্কার, কারণ এই ঘটনা নতুন নয়। একই ঘটনা ঘটেছিল গত বছরেও, ২০২০-র অগস্ট থেকে প্রাপ্য পেনশন ২০২১-এর জানুয়ারিতেও মেলেনি। অর্থাৎ, পুরসভার পক্ষ থেকে শূন্য কোষাগার এবং ব্যাপক ঋণভারের যে পরিস্থিতির কথা প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার কোনও পরিবর্তন বা উত্তরণ ঘটেনি, ঘটে না। তাই পেনশনের ফাইল আটকেই থাকে, বৃদ্ধ অশক্ত প্রাক্তন পুরকর্মীরা প্রতি দিন সকালে এসে ভিড় করেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন— ছবিটা পাল্টায় না।
যে পুরসভায় দায়িত্ব নেওয়ার সময়, শপথ গ্রহণকালেই মেয়র জানিয়ে দেন যে, তিনি আসলে ৭০০ কোটি ঋণের বোঝা মাথায় নিচ্ছেন, তার নিহিত বার্তাটি সহজেই অনুমেয়: অর্থাভাব। সমস্যা ও দুর্ভাগ্য এই, পুরসভার অর্থাভাবের জেরে ভুক্তভোগী হতে হয় কর্মীদেরই, অবসরপ্রাপ্তদের প্রাপ্য পেনশন দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরসভার হাত তুলে দেওয়ার প্রবণতা তারই বহিঃপ্রকাশ। অর্থসঙ্কট একা কলকাতা পুরসভার নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গেরই— সাম্প্রতিক কালে বহু প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী বারংবার বলেছেন: টাকা নেই। রাজ্য সরকারের না মেটানো বকেয়া টাকার পরিমাণ বেড়ে চলেছে বহু ক্ষেত্রেই— রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ নিয়ে হতাশা আক্ষেপ ও ক্ষোভের ইতিহাসটি পুরনো হতে বসেছে, ‘রাজ্যের প্রাপ্য টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না’, এই অভিযোগও। কেন্দ্র-রাজ্য রাজনীতির জটিল আবর্তে পড়ে রাজ্যের প্রাপ্য ক্রমশ সুদূরপরাহত হয়ে চলেছে। উপরন্তু রয়েছে রাজ্য সরকারের চলমান প্রকল্পগুলির চাপ। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, খাদ্যসাথী, স্নেহের পরশ থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডার— রাজ্য জুড়ে সাধারণ মানুষের খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য নাগরিক পরিষেবা পৌঁছে দিতে দায়বদ্ধ প্রকল্পগুলি চালাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার পরে কোষাগারে উদ্বৃত্ত দূরস্থান, সঞ্চয়ই থাকে নামমাত্র। ফল বিপুল ঋণ, বছরের পর বছর কর্মীদের প্রাপ্য মেটাতে না পারার ব্যর্থতা।
অর্থাভাবের দোহাই দিয়ে নোটিসে নিজেদের অপারগতার কথা জানানো যায় বটে, কিন্তু কলকাতা পুরসভাকে বুঝতে হবে, তাদের ব্যর্থতা স্রেফ আর্থিক নয়, তার চেয়েও বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ। অবসরপ্রাপ্ত পুরকর্মীরা আজ যে অর্থের জন্য পুরসভায় এসে ভিড় জমাচ্ছেন, তা তাঁদের প্রাপ্য; তাঁরা যে অবসরের পর পেনশন ও অন্য সুযোগসুবিধা বাবদ অর্থ পাবেন, চাকরি শুরুর সময়ে কলকাতা পুরসভাই তাঁদের সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সরকারি কর্মীদের পেনশন দেওয়া উচিত কি না তা ভিন্ন প্রশ্ন ও তর্ক, কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রসঙ্গটি মৌলিক— নাগরিক অধিকারের। কাজে বহাল করার সময় যে অঙ্গীকার পুরসভা করেছে, এখন টাকা নেই বলে সে শর্ত ও শপথ ভঙ্গ করা নাগরিক অধিকার হরণের নামান্তর। কলকাতা পুরসভাকে বুঝতে হবে, ন্যায়বিচারের মতোই, অধিকার বিলম্বিত হওয়া মানেও অধিকারের অস্বীকৃতি। আর্থিক পরিস্থিতি যা-ই হোক, প্রাক্তন কর্মীদের প্রাপ্য না মেটালে পুরসভা সেই অপরাধে অপরাধী হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy