মেয়েদের যে বয়সে স্কুল-কলেজে থাকার কথা, সে বয়সের মেয়েদের অর্ধেকই করছে কেবল ঘরকন্নার কাজ। ফাইল ছবি।
যে বয়সে মেয়েদের স্কুল-কলেজে থাকার কথা, নইলে প্রবেশ করার কথা কাজের জগতে, সে বয়সের মেয়েদের অর্ধেকই করছে কেবল ঘরকন্নার কাজ। পশ্চিমবঙ্গের এমন ছবিই উঠে এসেছে সাম্প্রতিক জাতীয় নমুনা সমীক্ষায়। পনেরো থেকে চব্বিশ বছরের বাঙালি মেয়েদের শিক্ষা, কর্মসংযুক্তিতে পিছিয়ে থাকার এই ছবি সারা দেশের ক্ষেত্রেই নিরাশাজনক, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা বিশেষ উদ্বেগজনক। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে গৃহকাজ-সর্বস্বতার এই হার (৪৯.৯ শতাংশ) জাতীয় হারের (৪৩ শতাংশ) চেয়ে বেশি। গ্রামীণ বাংলায় অর্ধেকেরও বেশি (৫৩ শতাংশ) মেয়ে শুধুমাত্র গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে যুক্ত। ফলে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য শিক্ষা ও নারী ক্ষমতায়নের জন্য রাজ্য সরকারের বিবিধ প্রকল্পের সাফল্য, বিশেষত কন্যাশ্রী প্রকল্পের সার্থকতা নিয়ে। মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে, অথচ স্কুলছুট মেয়েদের সংখ্যা কমানো যায়নি, নাবালিকা বিবাহের হারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশের শীর্ষে, অকালমাতৃত্বের হারও কিছুমাত্র কমেনি। কোভিড অতিমারি অবশ্যই প্রভাব ফেলেছে শিক্ষার চিত্রে, নানা ভাবে বিপন্ন করেছে নাবালিকা ও তরুণী মেয়েদের। কিন্তু সে কথা সারা দেশেই সত্য। পশ্চিমবঙ্গের এই ভয়ানক দশা কেবল অতিমারির সমস্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে না। কন্যাশ্রীর ‘সাফল্য’ প্রচার করতে সরকার যদি এমন বদ্ধপরিকর না হত, তা হলে প্রকল্পটির কাঠামো পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ থাকত। বার বার এমন ইঙ্গিত মিলেছে যে, মেয়েদের আঠারো বছর বয়স পূর্ণ হতেই পঁচিশ হাজার টাকার অনুদান দেওয়ার বিধি পরিবারকে বিয়ের আয়োজনের দিকে প্রণোদিত করেছে, মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার দিকে নয়। অন্য কিছু রাজ্যে এই ধরনের অনুদান এককালীন বড় অঙ্কে না দিয়ে, মাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে দেওয়া হয়। মেয়েদের উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণে সংযুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সেই ‘মডেল’ আরও বেশি কার্যকর কি না, বিবেচনা করা দরকার।
একই সঙ্গে দেখতে হবে স্কুল ও কলেজ শিক্ষার পরিকাঠামো, এবং কাজের সুযোগের দিকে। শিক্ষকের অভাবে, এবং শিক্ষার মানের প্রতি উপেক্ষার জন্য স্কুল-কলেজগুলি কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের কাছে অসার হয়ে উঠেছে। অর্থহীন নম্বরের পিছনে ধাওয়া করা তাদের পড়াশোনার প্রতি নিরুৎসাহ করছে। উন্নত জীবন, উন্নততর জীবিকার সন্ধান তাদের দিতে পারছে না স্কুল-কলেজ। প্রতিটি ব্লকে আইটিআই নির্মাণ, স্বল্পমেয়াদি পেশাগত প্রশিক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার। পরিকাঠামোর অভাবে, এবং প্রশিক্ষিতদের নিয়োগের সুযোগের অভাবে, সেগুলিও তরুণ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। এক দিকে ভারতে উচ্চশিক্ষায় সংযুক্ত তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা বিশ্বের নিরিখে অনেক কম, অন্য দিকে উচ্চশিক্ষিত, প্রশিক্ষিত যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণীরাও তাঁদের যোগ্যতা অনুসারে কাজ পাচ্ছেন না। অসংগঠিত ক্ষেত্রে যৎসামান্য পারিশ্রমিকে নিয়োগ, অথবা কেবলই কায়িক পরিশ্রম, আকর্ষণীয় নয় বলেও বহু মেয়ে থেকে যাচ্ছে গৃহস্থালির কাজে।
ঘরকন্নার কাজের গুরুত্ব কিছু কম নয়। গৃহকাজে নিযুক্ত মেয়েদের অবদান জাতীয় উৎপাদনের কতখানি, তার অনেক হিসাবনিকাশ হয়েছে। কিন্তু গৃহশ্রম মেয়েদের ক্ষমতায়নের পরিপন্থী হয়ে ওঠে, কারণ তাদের শ্রমার্জিত সম্পদের উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না পুরুষতান্ত্রিক পরিবার। বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা যে মেয়েদের মানব উন্নয়ন, মর্যাদা, এমনকি নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রমাণিত। তা সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলে কিশোরী-যুবতীদের ৫৩ শতাংশ কেবল ঘরকন্নায় দিন কাটাচ্ছে। নারী ক্ষমতায়ন, প্রথাগত শিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণের প্রকল্পগুলির নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy