Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Christmas 2023

কেন বড় দিন

জিশু খ্রিস্টের জন্মদিন বলে শোনা গেলেও, ২৫ ডিসেম্বরের কিন্তু সত্যিই তেমন কোনও প্রমাণিত ঐতিহাসিকতা আছে কি না, এ নিয়ে তত্ত্ব-তর্ক প্রচুর।

An image of Christmas

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:১৪
Share: Save:

বড়দিন কেন বড়? কূট প্রশ্ন, সন্দেহ নেই। আবার, ক্রিসমাস ডে পরিচয়ে অন্বিত দিনটিও কী ও কেন, সে প্রশ্নও কম কূট নয়। কেননা জিশু খ্রিস্টের জন্মদিন বলে শোনা গেলেও, ২৫ ডিসেম্বরের কিন্তু সত্যিই তেমন কোনও প্রমাণিত ঐতিহাসিকতা আছে কি না, এ নিয়ে তত্ত্ব-তর্ক প্রচুর। জিশু কবে জন্মেছেন, তার ঐতিহাসিক নথি আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না। বরং অনেক প্রাচীন কালে যখন ‘ইয়ুল’ বলে পরিচিত ছিল এই দিনটি, তাকে মনে করা হত সূর্যের দক্ষিণাবর্ত বা মকর-পরিক্রমার শেষ বিন্দু (উইন্টার সলস্টিস), এবং সেই দিক দিয়ে— ধর্মীয় নয়— প্রাকৃত গুরুত্বে অন্বিত। প্রাচীন খ্রিস্টীয় সমাজ সাধারণ ভাবে জিশুর জন্মানুষঙ্গে দিনটিকে জড়াত না, এমনকি এই যুক্তিও শোনা যেত যে জন্মদিন বলে কিছু হতে পারে না, বিশেষত সেই বড় মানুষজনের ক্ষেত্রে, যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন মানব-স্বার্থে। বরং মানবমঙ্গলের জন্য তাঁদের বলিদানের দিনটিকেই জন্মদিন বলে ধরা যেতে পারে, যদি জন্মদিন বলে আদৌ কিছু মানতে হয়। নিউ টেস্টামেন্টেও ২৫ ডিসেম্বরের কোনও গুরুত্ব বলা নেই। মনে করা হয়, আনুমানিক ২২১ অব্দ নাগাদ এই দিনটিকে জিশুর জন্মের সঙ্গে প্রথম বার যুক্ত করেছিলেন সেক্সটাস জুলিয়াস আফ্রিকানাস, যিনি ছিলেন জেরুসালেম-এর নামকরা ইতিহাসবিদ, বা ঠিক করে বলতে গেলে, ইতিহাসভিত্তিক কাহিনি-লেখক। কিন্তু তখনও দিনটিকে ‘ডে অব দ্য বার্থ অব দি আনকনকার্ড সান’ বলা হত। তাই কেউ কেউ ভাবেন, এখানেই হয়তো ক্রমে মিলে গিয়েছিল ‘সান’ (সূর্য) এবং ‘সান’ (পুত্র, অর্থাৎ ঈশ্বরপুত্র) অর্থাৎ জিশু— এই দুই শব্দ, মিলে গিয়েছিল প্রাকৃত ও ধর্মীয় ব্যঞ্জনা। আজও এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ঘাঁটলে এমন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রাখলে বুঝতে অসুবিধা নেই, কেন আজও মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশে জিশুর জন্মদিন বলে পালিত হয় জানুয়ারির ৬ বা ৭ তারিখ। ওই তালিকায় রয়েছে মিশর, ইথিয়োপিয়া, কিংবা বেলারুস, জর্জিয়া, সার্বিয়া, এমনকি রাশিয়ার কিছু অংশ। আর্মেনিয়ানরা পালন করে থাকেন ৬ জানুয়ারি। তবে কিনা, সেই পুরাকালে, রোমান চার্চ ২৫ ডিসেম্বরটিকেই বেছে নেওয়ার পর যেন এই বিতর্ক-ইতিহাসে একটি অদৃশ্য মীমাংসার যবনিকা নেমে এসেছিল, কেননা ক্রমে সেই রোমান খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির ধারাতেই স্নাত হয়েছিল ইউরোপের বহুলাংশ, এবং তার পর অদৃষ্টের ফেরে উপনিবেশ-যুগ শুরু হলে ইউরোপের এই ধারাই বিশ্বের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল একটি স্বীকৃত রূপ হিসাবে। বাস্তবিক, যা ছিল এক পারিবারিক উৎসব, চার্চে গিয়ে নিস্তরঙ্গ আরাধনার দিন, তা দাঁড়িয়ে গেল এক সামূহিক সামাজিক উৎসবে। এই ঘটনাকে মূলত উপনিবেশ-যুগের অবদান বললে নিশ্চয় ভুল হবে না। নিজ ভূমি থেকে দূরে, বহু দূরে, স্থানান্তরিত ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা এই ছুটির দিনটিতে স্বদেশে না থাকার ব্যথা অনুভব করতেন, এবং সম্মিলিত হয়ে নানা উৎসব দিয়ে ভরিয়ে তুলতেন দিনটিকে। কলকাতার দিকেই যদি তাকানো যায়, বিলিতি হাতে শহরের নতুন পত্তন হওয়ার পর প্রথম থেকেই এই দিনটিতে আমোদিত হয়ে উঠতেন শহরবাসী পশ্চিমিরা এবং পশ্চিমি সংস্কৃতিবহ্নিতে আকৃষ্ট ‘নেটিব’ পতঙ্গরা। সকলে মিলে ভিড় করতেন শহরের ‘সাহেব-পাড়া’য়। আজও ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রিসমাস দিনটি পারিবারিক মিলনের দিন, ভিতর দিকে তাকানোর দিন, অথচ ভারতে কিংবা এশিয়ার অন্যান্য উপনিবেশ-ইতিহাস অধ্যুষিত দেশে এই দিনটি হুল্লোড়-আনন্দের দিন, বাইরের উৎসবে ভেসে যাওয়ার দিন। আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে এখনও এই দিনটি ও তার পরের দু’-একটি দিন সব দোকান বন্ধ, সবার ছুটি, সবার বাড়ি ফেরার তাড়া— আর ভারত বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা নেপাল কিংবা মালয়েশিয়ার মতো দেশে বড়দিনের কেনাকাটা, হইচই, মাতামাতি আর বেড়ানোর ধুম।

এ ভাবেই দিনটি ভিতরে বাইরে দুই দিকেই ‘বড়’ হয়েছে ক্রমে। তা ছাড়া, স্পষ্ট কোনও ধর্মীয় নিদান না থাকার কারণেই হয়তো, ধর্মাচারও থেকেছে নামমাত্র, কিংবা অনুপস্থিত, এবং এক সঙ্গে এক উৎসবের ছাতার তলায় নিয়ে এসেছে নানা ভাষা নানা মত নানা ধর্মের মানুষকে। এই যেমন, মালয়েশিয়ার মতো ‘ইসলামি’ দেশটিতে বড়দিনই নাকি সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতীয় উৎসব। এই প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক, একেবারে গোড়ার প্রশ্নটিতে। ভেদাভেদ না মেনে সকলের কাছেই বড়দিন আনন্দের দিন হয়ে উঠতে পেরেছে বলেই হয়তো বড়দিন সত্যিই খুব বড় একটি দিন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy