রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী রেকর্ড সময়ে আবাস যোজনা প্রাপক তালিকা পরীক্ষা করার জন্য পুরস্কার দাবি করেছেন। ফাইল চিত্র।
উন্নয়নের প্রকল্পে বিধিলঙ্ঘনের অভিযোগে কেন্দ্র টাকা আটকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির অভিযোগ করেছেন। অথচ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার সংশোধিত তালিকা প্রকাশ হতে দেখা গেল, চোদ্দো লক্ষ অযোগ্য প্রার্থীর খোঁজ পেয়েছে রাজ্য সরকার, যা মোট প্রাপকের এক-চতুর্থাংশ। তবে কি কেন্দ্রের সন্দেহকে অমূলক বলা চলে? হয়তো আরও আগেই কঠোর হতে হত কেন্দ্রকে। কারণ, এটি সম্ভাব্য প্রাপকদের তালিকা। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা শুরু হওয়ার পরে এখনও পর্যন্ত যত জন অনুদান পেয়েছেন, তাঁদের যোগ্যতা এ ভাবে যাচাই করা হয়নি। তবে বারংবার সংবাদে উঠে এসেছে যে, দরিদ্র পরিবারের জন্য পাকা বাড়ি তৈরির সরকারি অর্থ দিয়ে রাজ্যের গ্রামে তৈরি হয়েছে প্রাসাদোপম বাড়ি, দোকান, ক্লাব। প্রাপকের পারিবারিক আয়, জমিহীনতা, জব কার্ডে কাজের পরিমাণ— তালিকাভুক্তির সব শর্ত ছাপিয়ে উঠেছে একটিই বিষয়, তা হল শাসক দলের সঙ্গে প্রাপকের ঘনিষ্ঠতা। কেন তৃণমূল সরকার এ রাজ্যে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের শর্তগুলি রক্ষা করতে পারছে না, তা কেবল প্রশাসনের কর্মকুশলতার প্রশ্ন নয়, এক অতিকায় নৈতিক সঙ্কট হয়ে উঠেছে।
এ রাজ্যে অবশ্য যে কোনও সঙ্কটই দলীয় রাজনীতির খেউড়ে পর্যবসিত হয়। এ ক্ষেত্রেও সেই কুনাট্য থেকে অব্যাহতি মেলেনি। রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী রেকর্ড সময়ে আবাস যোজনা প্রাপক তালিকা পরীক্ষা করার জন্য পুরস্কার দাবি করেছেন। পাঁক মাখার প্রতিযোগিতায় জিতে জাঁক করার নজির দেখল রাজ্যবাসী। কথার কসরত যতই চলুক, প্রথমে প্রকল্পের ‘বাংলা আবাস যোজনা’ নাম বাতিল করে ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’ ফিরিয়ে আনা, অতঃপর প্রাপক তালিকায় প্রতি চার জনের এক জনকে ‘ভুয়ো’ বলে স্বীকার করা, এ দুটোই রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও প্রশাসনিক অপদার্থতার স্বাক্ষর হয়ে থাকবে। তবে এই সংশোধিত তালিকায় সম্ভবত দুর্নীতির প্রকৃত পরিসর ধরা পড়েনি। কারণ, কত গৃহহীন মানুষ তালিকায় স্থান পাননি, তার হিসাব এতে নেই। সংশোধনের পর্বে কেবল নাম বাদ দেওয়ার ক্ষমতাই ছিল সরকারি আধিকারিক ও কর্মীদের, যোগ্যদের অন্তর্ভুক্ত করার অধিকার ছিল না। তালিকায় যাঁরা অনুপস্থিত, তাঁরা কেউ হয়তো নেতাদের উৎকোচ দিতে অক্ষম, কেউ বা বিরোধী বলে বর্জিত। অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, নথিপত্রের গরমিল অথবা ডিজিটাল মাধ্যমে বাছাইয়ের পদ্ধতির জন্যও বহু যোগ্য ও ন্যায্য আবেদন বাতিল হয়। মানব উন্নয়নের নিরিখে অযোগ্যকে অনুদান দেওয়ার থেকেও বড় অপচয় যোগ্যের বঞ্চনা। এই ত্রুটির সংশোধন দ্রুততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে করা প্রয়োজন।
সরকারি প্রকল্পের প্রাপকের তালিকা নির্মাণ, নজরদারি ও সংশোধনের যে প্রশাসনিক বিধি তৈরি করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য, সেখানে আজ স্থানীয় নাগরিকের অংশীদারির থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় ‘জিয়োট্যাগিং’-সহ নানা প্রযুক্তিকে। তাতে দুর্নীতি কমেনি। স্বচ্ছতা আনতে সরকারি কর্তাদের কাজের বোঝা চেপেছে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের উপরে, যদিও গ্রামের রাজনৈতিক নকশায় এই মহিলারা অসুরক্ষিত, সহায়হীন। এগারো বছর আগে উদ্ধত, নিষ্ঠুর রাষ্ট্রক্ষমতার সম্মুখে দরিদ্র, নির্যাতিতের অসহায়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ, আজ একশো দিনের কাজ, ন্যায্য মূল্যে ফসল বিক্রয়, গৃহ নির্মাণ— সর্বত্রই সংশয় দেখা দিচ্ছে, তৃণমূল সরকারের টাকা কতটা দরিদ্রের উন্নয়নে যাচ্ছে, আর কতটা মধ্যস্বত্বভোগীর পোষণে। নতুন নতুন প্রকল্পের ঘোষণা সাময়িক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। কিন্তু উন্নয়নের প্রধান প্রকল্পগুলিতে দুর্নীতি এমন ব্যাপক হলে রাজনীতির সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের সংযোগটিই দুর্বল হয়ে পড়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy