ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হইয়াছে। ‘খেলা হইবে’ বলিয়া নিজ দলের চিহ্নিত ‘খেলোয়াড়’দের ভোটের মাঠেও নামাইয়া দিয়াছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য প্রধান দলগুলি যখন প্রথম দুই পর্বের অনধিক ষাটটি আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশেও কালক্ষেপ করিয়াছে, মমতা তখন শুধু পাহাড়ের তিনটি কেন্দ্র বিমল গুরুঙ্গ-বিনয় তামাংদের উপর রাখিয়া বাকি ২৯১ কেন্দ্রে আপন দলের সব প্রার্থীর নাম ঘোষণা করিয়া দেন। স্পষ্টতই এই প্রত্যয়ী তৎপরতার পিছনে রহিয়াছে দলের উপর মুখ্যমন্ত্রীর সর্বময় কর্তৃত্ব, কিছু কিছু আঞ্চলিক নেতার দলত্যাগের পরে যে কর্তৃত্ব আরও প্রবল হইয়া থাকিতে পারে। প্রার্থী তালিকা ভোট-যুদ্ধের অতি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বিশেষত শাসক দলের ক্ষেত্রে তাহার গুরুত্ব সমধিক। তাহার স্কন্ধে প্রত্যাশার ভার বেশি থাকে। ফলে দলের ভিতরে ও বাহিরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চাপ বহিতে হয়। মাথায় রাখিতে হয় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার অঙ্ক এবং রাজনীতিও। বস্তুত, তালিকা তৈয়ারির কাজটিও একটি কঠিন খেলা। ভারসাম্যের খেলা।
প্রার্থী তালিকা সম্পর্কে প্রথমেই বলিবার যে, কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সহ প্রায় ষাট জন বিধায়ককে মনোনয়ন দেওয়া হয় নাই, অনেক ক্ষেত্রেই বয়স ও অসুস্থতার কারণে। মনে রাখা দরকার, জনপ্রতিনিধিরা অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এক বার সাংসদ, বিধায়ক ইত্যাদি আসন দখল করিতে পারিলে সেই ‘সুফল’ জীবনের শেষ দিন অবধি ভোগ করিয়া চলিবেন। এ হেন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দলের প্রার্থী তালিকায় বৃদ্ধতন্ত্রের প্রভাব খর্ব করিবার চেষ্টা কেবল যুক্তিসঙ্গত সুচিন্তার পরিচায়ক নহে, তাহাতে ভবিষ্যৎমুখী মানসিকতার আশাপ্রদ সঙ্কেত আছে। উনিশ-কুড়ি জন প্রার্থীর কেন্দ্র বদল করিয়াও মুখ্যমন্ত্রী দৃশ্যত কায়েমি স্বার্থের প্রতিপত্তি বা তাহার সম্ভাবনা কমাইতে চাহিয়াছেন। ভোটের ফলাফলে এই পদক্ষেপগুলির কী প্রভাব পড়িবে, তাহা কাহারও জানা নাই। কিন্তু তৃতীয় দফা সরকার গড়িবার দৌড়ে নামিয়া ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’-র বাস্তব দাবিগুলি যদি দলনেত্রীর বিচারে গুরুত্ব পাইয়া থাকে, দশ বছর যাবৎ ক্ষমতার মেদ জমিতে থাকা শাসক দলের প্রার্থী তালিকায় আগামী দিনের অন্যতর ছবি দেখাইবার উদ্যোগ যদি তিনি করিয়া থাকেন, তাহা সুলক্ষণ বইকি।
সেই লক্ষণ আরও অনেক জোরদার হইতে পারিত, যদি প্রার্থী নির্ধারণে যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়নকে প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়া হইত। বিধায়ক বা মন্ত্রী হিসাবে যাঁহারা ব্যর্থ বা অমনোযোগী, তাঁহাদের ছাঁটিয়া ফেলিবার সুযোগ ছিল। বিশেষত ‘তারকা প্রার্থী’দের অধিকাংশের সম্পর্কেই বড় রকমের সংশয়। বিভিন্ন পরিসর হইতে তারকাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে টানিয়া আনিয়া তাঁহাদের জনপ্রিয়তাকে দলের মূলধন হিসাবে ব্যবহার করিবার প্রবণতা এই রাজ্যে বহুলাংশেই তৃণমূল কংগ্রেসের সৃষ্টি— এখন যাহা কুনাট্যের মূর্তি লইয়াছে, বিজেপির কল্যাণে যে মূর্তি সহস্রদলে প্রকট হইতেছে, এমনকি গতকালের ব্রিগেড সভার তুরুপের তাস হিসাবেও পরিগণিত হইয়াছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, তারকাদের অনেকেই জনপ্রতিনিধি হিসাবে ব্যর্থ, অনেকে সেই ভূমিকা পালনের ন্যূনতম চেষ্টাও করেন নাই। সেই ট্র্যাডিশন কি সমানেই চলিবে? অবশ্য তারকা প্রার্থী নির্বাচনের মধ্যেও এক রকম রাজনীতির হিসাব আছে, বুঝিতে অসুবিধা নাই। কিন্তু সেই হিসাব সহজ পথে বাজিমাত করিবার। সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথটি কিন্তু এই অভিমুখে অর্জনীয় নহে, বিচক্ষণ রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা জানেন। রাজনীতির দুর্ভাগ্য— দক্ষিণ বাম মধ্য, সব রঙের দলের নিকটই প্রধান লক্ষ্য এখন ক্ষমতার অঙ্ক, এবং, সেই অঙ্ক মিলাইবার জন্য, জনতার বিনোদন। জনস্বার্থ রক্ষার প্রশ্নটি, অন্তত প্রার্থী তালিকার ক্ষেত্রে, পিছনে পড়িতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy