Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
United Nations

কাপুরুষের নীরবতা

কেন্দ্রীয় প্রকল্প বর্তমানে রেশনের মাধ্যমে একাশি কোটি মানুষকে বিনামূল্যে শস্য দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জ দেখাচ্ছে, একশো কোটিরও বেশি নাগরিক প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছেন না।

UN

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:১১
Share: Save:

ভারতে চার জন নাগরিকের তিন জনই যথেষ্ট খাবার পান না, জানাল রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিবেদন। ছবিটি কেবল বিপন্নতার নয়, লজ্জারও— খাদ্য-নিরাপত্তায় ভারত চিন, ইরান, বাংলাদেশের পিছনে। আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশে পেট ভরে পুষ্টিকর খাবার খেতে অসমর্থ বড় জোর এক-দু’শতাংশ মানুষ, ভারতে চুয়াত্তর শতাংশেরই সেই ক্ষমতা নেই। খাদ্য-নিরাপত্তাকে যে কেবল রেশনের চাল-গম বিতরণের প্রশ্নে সীমিত রাখা চলে না, এই সমীক্ষা তা মনে করিয়ে দিল। পুষ্টির জন্য প্রয়োজন ডিম, ফল, দুধ, আনাজের মতো অত্যাবশ্যক খাবার, যার সব গণবণ্টনের মাধ্যমে পৌঁছনো অসম্ভব। এগুলিকে দেশের অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসাই হল সরকারের কাজ। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে এক দিকে কর্মহীনতা বেড়েছে, মজুরি কমেছে, অন্য দিকে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। দুধ-ডিমের মতো খাবার যে দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের কাছে, বিশেষত মহিলাদের কাছে পৌঁছচ্ছে অতি সামান্য, পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ থেকে সম্প্রতি তা জানা গিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষুধা সূচকেও ভারত পিছনের সারিতে। এর ফলে এক দিকে যেমন ভারতে মানব উন্নয়ন তথা দারিদ্র নিরসনের দাবি প্রশ্নের মুখে পড়েছে, অন্য দিকে তেমনই সরকারি খাদ্য সহায়তা প্রকল্পগুলির কার্যকারিতা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় প্রকল্প বর্তমানে রেশনের মাধ্যমে একাশি কোটি মানুষকে বিনামূল্যে শস্য দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জ দেখাচ্ছে, একশো কোটিরও বেশি নাগরিক প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছেন না। জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে প্রাপ্য সহায়তা দিতে কেন্দ্র ব্যর্থ। খাদ্যের অধিকার আন্দোলনে শামিল সমাজকর্মীরা বহু পূর্বেই সতর্ক করেছিলেন যে, ২০১১ সালের জনগণনার উপর নির্ধারিত সংখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের উপভোক্তা সংখ্যা স্থির করায় বহু নাগরিক গণবণ্টন ব্যবস্থার পরিধি থেকে বাদ পড়ছেন। এই ভ্রান্তি ও ব্যর্থতার জন্য নির্বাচিত সরকার জবাবদিহি করবে, সংসদে বিতর্কের ঝড় উঠবে, এমনই প্রত্যাশিত ছিল। বাস্তবে মিলল কঠিন নীরবতা। তার কারণ, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ভারতে অপুষ্টির যে চিত্র উঠে এসেছে, কেন্দ্রীয় সরকার তাকে নস্যাৎ করেছে, এবং নিজের বয়ান প্রকাশ করে কথাবার্তায় ইতি টেনেছে। সেই বয়ান হল, যা করা দরকার, সরকার তার সবই করছে, সমালোচকরা ভ্রান্ত, আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। সংবাদমাধ্যমে বা নাগরিক সমাজে দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণ নির্ধারণ, প্রতিকারের উপায় খোঁজার যতটুকু দাবি উঠেছে, সে সবই সরকারের নীরবতার পাঁচিলে প্রতিহত হয়ে ফিরে এসেছে।

এই নীরবতাকে ক্ষমতার দম্ভ বলে মনে হতে পারে। বস্তুত তা কাপুরুষের বাক্যহীনতা। ব্যর্থতা স্বীকার করা, সমালোচনার সম্মুখীন হওয়া, প্রতিকারের উপায় খোঁজার সাহস কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। নীরবতার অপর উদ্দেশ্যটি রাজনৈতিক— পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিনামূল্যে আরও পাঁচ বছর খাদ্যশস্য বিতরণের কথা যে ঘোষণা করেছেন নরেন্দ্র মোদী, তাকে তাঁর দল ‘মোদী কি গ্যারান্টি’ বলে প্রচার করেছে। যেন খাদ্য-নিরাপত্তা রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়। তা বস্তুত নাগরিকের অধিকার— খাদ্য-নিরাপত্তা আইন পাশ করে দেশবাসীকে খাদ্যের নিরাপত্তার ‘গ্যারান্টি’ দেওয়া হয়েছিল ২০১৩ সালেই। যে কোনও নির্বাচিত সরকার দেশবাসীর যথাযথ পুষ্টিবিধান নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কুড়ি কোটিরও বেশি মানুষ রেশনের আওতা থেকে বাদ থাকলে স্পষ্ট হয় যে, মোদী তাঁর ‘গ্যারান্টি’ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রচারের অসারতা এ ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ছে বার বার, বিভিন্ন সমীক্ষায়। আর বার বার সে সব তথ্যের সত্যতা নস্যাৎ করে, উপেক্ষা করে মুখ বাঁচাচ্ছে সরকার। এই নীরবতাকে আঘাত করাই এখন নাগরিক সমাজের কর্তব্য।

অন্য বিষয়গুলি:

United Nations Food Poverty India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy