বৃহত্তর সমাজ এখনও শিক্ষাকে একটি বিচ্ছিন্ন পরিসর হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত। প্রতীকী ছবি।
জর্জ অরওয়েল-এর ১৯৮৪ নামক উপন্যাসটি যে আধিপত্যকামী, কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বোঝার ‘মানে বই’ হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, সে কথা পাঠকমাত্রেই জানেন। মজার কথা হল, ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত বইটি আজও, প্রায় পঁচাত্তর বছরের ব্যবধানেও, কর্তৃত্ববাদী শাসনের চলন ব্যাখ্যা করতে একই রকম সক্ষম। অর্থাৎ, কর্তৃত্ববাদের চরিত্র পাল্টায়নি, ধরনধারণও পাল্টায়নি। অরওয়েল লিখেছিলেন, বর্তমানকে যারা নিয়ন্ত্রণ করে, অতীতের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই— আর, অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা যাদের আছে, ভবিষ্যৎকেও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ, ভবিষ্যৎকে— ভবিষ্যতের নাগরিকের মনকে— নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই কর্তৃত্ববাদী শাসন ইতিহাস পাল্টে দিতে চায়। সেই প্রচেষ্টার স্বরূপ ভারত বিলক্ষণ জানে। সম্প্রতি আরও এক বার ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে রদবদল হল। এনসিইআরটি-র উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়ল মোগল শাসনকাল সংক্রান্ত অধ্যায়, ছাঁটা হল গান্ধী-হত্যার পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ, কাটছাঁট করা হল জওহরলাল নেহরু বিষয়ক পাঠেও। এই অংশগুলিই বাদ পড়ল কেন, তা এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে, তার ব্যাখ্যা অনাবশ্যক। কেউ অবশ্য প্রশ্ন করতে পারেন যে, এনসিইআরটি-র পাঠ্যক্রম তো এখনও নাগপুরে সঙ্ঘ পরিবারের সদর দফতর থেকে নির্ধারিত হয় না— যাঁরা সেই দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরা নিজেদের ‘শিক্ষাবিদ’ হিসেবে দাবি করে থাকেন। তা হলে, পাঠ্যক্রমটি এমন রাজনীতির অনুজ্ঞানুসারেই ছাঁটা হল কেন? আজকের ভারতে অবশ্য এই প্রশ্নও নিরর্থক— রাজনৈতিক শাসকদের প্রতি আনুগত্যই যখন যোগ্যতার শ্রেষ্ঠ মাপকাঠি, তখন আর ভিন্নতর পরিণতি আশা করে লাভ কী?
বৃহত্তর সমাজ এখনও শিক্ষাকে একটি বিচ্ছিন্ন পরিসর হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত— এমন একটি পরিসর, যেখানে প্রাত্যহিক রাজনীতির কালিমা প্রবেশ করে না, সমাজের অন্ধকারগুলি যেখানে ছায়া ফেলে না। আদর্শ পরিস্থিতিতে তেমনটাই হওয়া উচিত, কিন্তু সে আদর্শ কবেই ভেসে গিয়েছে যমুনার কালো জলে। অতএব, বর্তমানে গৈরিক উগ্র জাতীয়তাবাদের যে বাস্তুতন্ত্র গঠিত হয়েছে, শিক্ষাকে তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবেই বর্তমান পদক্ষেপটিকে দেখা প্রয়োজন। সেই বাস্তুতন্ত্রে সোশাল মিডিয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হল বলিউড-এর ‘ইতিহাস-নির্ভর’ চলচ্চিত্র। সেই পরিসরে যে মিথ্যাগুলি পরিবেশিত হয়, এবং স্কুল-পাঠ্যক্রম থেকে ইতিহাসের যে অংশ বাদ পড়ে যায়, তার মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। সোশাল মিডিয়া ও বলিউডের ‘পপুলার’ সংস্কৃতি যে ‘ইতিহাস’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, স্কুলের পাঠ্যক্রমে যেন তার পরিপন্থী কোনও ভাষ্য না থাকে, তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
এই বাস্তুতন্ত্রের অন্য একটি দিক, শিক্ষার প্রতি অসম্মান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেশ কয়েক বছর আগে যার বীজমন্ত্রটি শুনিয়ে রেখেছিলেন, ‘হার্ভার্ড বনাম হার্ড ওয়ার্ক’। এই দুইয়ের মধ্যে যে কোনও বিরোধ নেই, বরং সাযুজ্য আছে, সে আলোচনা অন্যত্র। এই বীজমন্ত্রে নিহিত রয়েছে একটি আহ্বান— নাগপুরের পাঠশালার পড়ুয়া নন, এমন যে কোনও বিদ্যাব্রতীকে অবজ্ঞা করে চলে। সেই তালিকায় অমর্ত্য সেন থেকে রোমিলা থাপর, বহু দিকপালই রয়েছেন। তাঁদের বিদ্যাচর্চার দুনিয়া বহুলাংশে পৃথক, কিন্তু এক জায়গায় মিল রয়েছে তাঁদের— তাঁরা প্রত্যেকেই ভারতের বহুত্বে বিশ্বাসী; ভারতকে তাঁরা প্রকৃতার্থেই মানবতীর্থ বলে চেনেন। এক দিকে তাঁদের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার, এবং অন্য দিকে পাঠ্যক্রম থেকে এমন প্রসঙ্গ মুছে দেওয়া যাতে সেই বহুত্বের প্রমাণ রয়েছে— এই দ্বিমুখী অস্ত্র জনমানসে এই বিদ্বজ্জনদের বৈধতা হরণের প্রক্রিয়াটিকে দ্রুততর করতে পারে। উগ্র গৈরিক বাস্তুতন্ত্র তাতে নিষ্কণ্টক হয়। ভবিষ্যৎটিও তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy