প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ সম্পন্ন হইয়াছে দশ দিন আগে, ‘বিটিং দ্য রিট্রিট’-এর পরেও সপ্তাহ ঘুরিয়া আসিল, রাজধানী উত্তরোত্তর রণভূমির রূপ ধারণ করিতেছে। ধৃতরাষ্ট্র আজ সহসা হস্তিনাপুরে উপস্থিত হইলে নিশ্চয়ই সঞ্জয়কে সম্মুখে বসাইয়া সর্বাগ্রে জানিতে চাহিতেন, কী করিয়া এমন কুরুক্ষেত্র বাধিল? সঞ্জয় অতীত হইয়াছেন, এখন তথ্য সংগ্রহ ও সম্প্রচারের সহস্র মাধ্যম অষ্টপ্রহর জাগ্রত ও সজাগ। ইন্টারনেট বন্ধ করিয়া, টুইটারকে ধমক দিয়া সেই সহস্রলোচনের দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করিবার ক্ষমতা মহাশক্তিধর কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাহার অতিপরাক্রমী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও নাই। অতএব, কুরুরাজ না জানিতে পারেন, দেশ ও দুনিয়া বিলক্ষণ অবগত আছে, দিল্লির পরিস্থিতি কেন এবং কী ভাবে এমন ভয়াবহ হইয়া উঠিল। সাধারণ বুদ্ধিতে এই পরিণতি সত্যই অবিশ্বাস্য। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশি ব্যারিকেড, কাঁটাতার, ট্রেঞ্চ, রাজপথে গাঁথিয়া দেওয়া সারি সারি লৌহকীলক— আক্ষরিক অর্থেই রণসজ্জা। রাজধানীর বিভিন্ন ‘সীমান্ত’ হইতে প্রতিনিয়ত ভাসিয়া আসিতেছে নানাবিধ সংবাদ, ঠিক যেমনটি যুদ্ধের সময় আসে। সহসা দেখিলে মনে হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, ভারতের সহিত বুঝি প্রতিবেশী কোনও শক্তির যুদ্ধ বাধিয়াছে! এবং, কিমাশ্চর্যমতঃপরম্, বিদেশ মন্ত্রক ‘ভারতের নামে অপপ্রচার’ প্রতিরোধে তৎপর হইয়া উঠিয়াছে, যুদ্ধের সময় ঠিক যেমনটি ঘটে! ভয় হয়, যে কোনও মুহূর্তে হাল্লার রাজা ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া বসিবেন এবং ‘যুদ্ধ! যুদ্ধ!’ বলিয়া হুঙ্কার শুরু করিবেন।
কবে কী ভাবে এই পর্বের অবসান ঘটিবে, তাহার জন্য কাহাকে কতটা মূল্য গনিতে হইবে, সেই সকল প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু ইতিমধ্যে যাহা ঘটিয়া গিয়াছে তাহাই ভারতের ইতিহাসে বিপুল কলঙ্কের অভিজ্ঞান হিসাবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে, কোনও মহান খেলোয়াড় বা মহত্তর চিত্রাভিনেতার কথামৃত তাহার মলিনত্ব মোচন করিতে পারিবে না। সেই কলঙ্ক যুগপৎ ঔদ্ধত্যের এবং অপদার্থতার। বুঝিয়া অথবা না-বুঝিয়াই, কেন্দ্রীয় সরকারের নায়কনায়িকারা ইদানীং যে ‘গুরুবর’-এর বিবিধ উক্তি আলটপকা উদ্ধৃত করিয়া থাকেন, তিনি আপনার গানে লিখিয়াছিলেন: তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি। এই আবেদনের অর্থ বুঝিবার সাধ্যটুকু থাকিলে বর্তমান দিল্লীশ্বররা বুঝিতেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুশাসক হইবার কোনও যোগ্যতা তাঁহাদের তিলপরিমাণেও নাই। যাহা ভূরিপরিমাণে আছে, তাহার নাম অহঙ্কার। সেই অহঙ্কারের কারণেই তাঁহারা এই প্রাথমিক সত্যটি ভুলিয়া গিয়াছেন যে, ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব আসে, এবং গণতন্ত্রে সেই দায়িত্বের প্রথম ও প্রধান শর্তটির নাম শুশ্রূষা— নাগরিকদের কথা শুনিবার আন্তরিক আগ্রহ।
‘ভুলিয়া গিয়াছেন’ বলিলে হয়তো তাঁহাদের প্রতি অবিচার হয়, কারণ এই সত্যটি কস্মিন্কালেও তাঁহাদের জানাই ছিল না। সেই কারণেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস ধরিয়া শাসকরা সমস্যাকে জটিল হইতে জটিলতর করিয়া তুলিয়াছেন, বিক্ষুব্ধ কৃষকদের উত্তরোত্তর মরিয়া হইয়া উঠিতে বাধ্য করিয়াছেন, এমনকি আজও, আক্ষরিক অর্থে দুনিয়ার হাটে চূড়ান্ত অমর্যাদার শিকার হইবার পরেও তাঁহাদের আত্মসংশোধনের কোনও তাগিদ নাই, বরং অসহিষ্ণুতার পর্দা ক্রমশ চড়িতেছে; ছল, বল এবং বিবিধ ন্যক্কারজনক কৌশলের প্রয়োগ ক্রমশ জোরদার হইতেছে। সংসদের অধিবেশনে বিরোধীরা তাঁহাদের রকমারি ক্ষুদ্রস্বার্থ এবং ভয়ভীতি সামলাইয়া কতটুকু কার্যকর প্রতিস্পর্ধা সংগঠন করিতে পারিবেন, বলা কঠিন। কিন্তু প্রশ্নটি নিছক শাসক বনাম বিরোধী রাজনীতির নহে, প্রশ্ন ভারতীয় গণতন্ত্রের সার্থক অস্তিত্ব লইয়াই। দিল্লি নামক রণভূমির বাতাস ক্রমশই দীর্ঘশ্বাসে ভারী হইয়া উঠিতেছে। গণতন্ত্রের দীর্ঘশ্বাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy