পশ্চিমবঙ্গের রাস্তা ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কেন্দ্র বড় অঙ্কের টাকা মঞ্জুর করেছে, যার ফলে চলতি আর্থিক বছরে বরাদ্দ বাড়ছে প্রায় ছ’গুণ। এর একটি বড় অংশই খরচ হবে উত্তরবঙ্গে, বিশেষত ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত শিলিগুড়ির সঙ্কীর্ণ ভূখণ্ডে সড়ক সম্প্রসারণ এবং পরিবহণের উন্নতির জন্য। এমন সুসংবাদ এ রাজ্য বহু দিন পায়নি। অনর্গল কলহই যখন কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের স্থায়ী সুর হয়ে উঠেছে, তখন পরিকাঠামো নির্মাণে যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঊর্ধ্বে ওঠার আগ্রহ দেখিয়েছে দুই পক্ষ, সেটা রাজ্যবাসী তথা দেশবাসীর কাছে অবশ্যই আশাব্যঞ্জক সংবাদ। কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক এবং রাজ্যের পূর্ত দফতর যৌথ ভাবে উত্তরবঙ্গের রাস্তা সংস্কারের কাজ করবে। ঘোষিত নির্মাণ ও সংস্কারগুলি নতুন নয়, ২০১৪-১৫ সাল থেকেই উত্তরবঙ্গের সড়ক পরিকাঠামো উন্নয়নের নকশা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। আজ কেন্দ্রের বাড়তি তৎপরতার মূল কারণ ভূ-রাজনীতি— উত্তরবঙ্গের রাস্তাগুলি, বিশেষত ‘চিকেন নেক’ করিডর প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান, এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির সঙ্গে সংযোগের প্রধান উপায়। খুব কাছাকাছি রয়েছে বাংলাদেশ এবং চিনের সীমান্ত। ভারত-চিন সীমান্ত গত কয়েক বছরে ক্রমশ স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। সাঁজোয়া গাড়ি-সহ সেনাবাহিনীর যানবাহনের গতি সীমান্ত পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রাখার পরিকাঠামো প্রস্তুত রাখতে চায় কেন্দ্র। এই তাগাদা থেকে সিকিমগামী দশ নম্বর জাতীয় সড়ক সংস্কার, শিলিগুড়ির ‘চিকেন নেক’ করিডর-এর সম্প্রসারণের পাশাপাশি ছোট-বড় কয়েকটি নদী-সেতুর সংস্কার করে একটি সার্বিক সড়ক পরিকাঠামো তৈরির এই পরিকল্পনা নিচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য।
কৌশলগত দিক থেকে উত্তরবঙ্গের সড়ক ও পরিবহণের পরিকাঠামোর উন্নতির প্রয়োজন অপরিসীম। বাণিজ্যিক কারণেও তার প্রয়োজন কম নয়। ভারতের যে কোনও রাজ্য থেকে সড়ক পথে উত্তর-পূর্ব ভারতে যেতে হলে এই সঙ্কীর্ণ পরিসরটি দিয়েই যেতে হয়। অতএব তার সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। ভারতে অর্ধেকেরও বেশি পণ্যের পরিবহণ হয় সড়কপথে। অর্থনীতিতে সড়কের গুরুত্ব বোঝাতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডিকে উদ্ধৃত করেন। কেনেডি বলেছিলেন, আমেরিকা ধনী বলে তার সড়কগুলি উন্নত, এমন নয়, দেশের সড়কগুলি উন্নত বলেই আমেরিকা ধনী হয়েছে। গডকড়ী দাবি করেছেন, ২০২৪ সালের মধ্যেই ভারতের সড়ক পরিকাঠামো আমেরিকার সমান হবে। প্রতি দিন পঞ্চাশ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক নির্মাণ এখন সরকারের লক্ষ্য। বর্তমানে সড়কপথের মোট দৈর্ঘ্যের নিরিখে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয়।
রাজ্যবাসীর কাছে অবশ্য সড়ক ও পরিবহণের উন্নয়নে বাড়তি বরাদ্দ তাঁদের দৈনন্দিন সমস্যা থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসবে। উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের কাছে দার্জিলিং মোড়, ভক্তিনগর থানা মোড়, চেকপোস্টের যানজট প্রতি দিনের যন্ত্রণা। সেবক-রংপো ধসপ্রবণ রাস্তাটির দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার, তিস্তার উপর ব্রিটিশ আমলের করোনেশন সেতুর বিকল্প সেতু নির্মাণের প্রস্তাব, সেবক-রংপো রেল পরিষেবা, শিলিগুড়িকে ঘিরে রিং রোড, এশিয়ান হাইওয়ে-২ আরও সম্প্রসারিত করা, এ সবই দীর্ঘ দিনের দাবি। পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্রকে সুরক্ষিত রাখার দিকটিও অবহেলিত না হয়, সে কথা মনে রাখতে হবে। বিশেষত পাহাড়ের বুকে বৃহৎ কংক্রিটের নির্মাণকে উন্নয়নের স্বাক্ষর বলে চিহ্নিত করা যায় কি? ভূ-রাজনীতির কৌশল অথবা বাণিজ্য প্রসারের উচ্চাশা, কোনও কারণেই পরিবেশের স্থিতিস্থাপকতার প্রতি অসতর্ক হওয়া চলে না। উত্তরবঙ্গে পরিকাঠামো গঠনের এই নতুন সূচনাপর্ব যেন হয় সুস্থায়ী উন্নয়নের পথ।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy