—প্রতীকী ছবি।
গোপন কথার চরিত্রই হল যে সে শেষাবধি রয় না, ‘রবে না গোপনে’। তাই গোপনকারীর চেষ্টা কোনও না কোনও ভাবে মাঠে মারা যায়। তাই পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা নব্বই হাজার পেরিয়েছে, এক লক্ষও ছাড়িয়ে যেতে পারে বছর ফুরোনোর আগে, এ সংবাদ যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা হোক, সংবাদটি যথেষ্ট-জ্ঞাত। এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও, সংবাদটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। রাজ্য সরকার যে ভাবে রোগের তথ্য-পরিসংখ্যান গোপন করেছে, জাতীয় পোর্টালে রাজ্যের তথ্য দেয়নি মাসের পর মাস, তাতে প্রকৃত পরিস্থিতি যে ভাল নয়, তা আন্দাজ করা যাচ্ছিল। এখন রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের অভ্যন্তরীণ তথ্যে প্রকাশিত, পশ্চিমবঙ্গই ডেঙ্গি সংক্রমণের সংখ্যায় সম্ভবত দেশে প্রথম। প্রথম প্রশ্ন হল: ডেঙ্গির তথ্য কি নিয়মিত প্রকাশ করার কথা ছিল না? রোগী নিজের অসুখ গোপন করলে যেমন তা বেড়ে যায়, তেমনই সরকার তথ্য গোপন করলে সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়াতে বাধ্য নয় কি? ওষুধ ও চিকিৎসকের মতোই, তথ্য-পরিসংখ্যানও তো সংক্রামক ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধের অন্যতম অস্ত্র। অথচ পশ্চিমবঙ্গে তথ্য বিরল, বিভ্রান্তি প্রচুর। গত নভেম্বরে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, ২০২২-এ তখনও অবধি ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা এগারো। অথচ, সে সময়ে সংবাদে প্রকাশিত তথ্যই বলছিল— মৃত্যু পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, ‘অজানা জ্বর’ কিংবা ‘কো-মর্বিডিটি’ বলে কিছু মৃত্যুতে ছাপ দেওয়ার অর্থ, প্রকৃত তথ্য গোপন করা। এতে বিরোধীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে হয়তো কিছুটা সুবিধা হয় শাসক দলের, কিন্তু সরকারের কর্তব্য পালন করা হয় কি? জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত জরুরি তথ্য গোপন করা নেতা-আধিকারিকরা প্রায় ‘স্বাভাবিক’ করে তুলেছেন।
তবে তথ্য জোগানোর যা প্রধান উদ্দেশ্য— রোগ প্রতিরোধ— তা থেকে দৃষ্টি সরালে চলবে না। অসম্পূর্ণ নির্মাণ, পরিত্যক্ত বাড়ি, ফাঁকা জমি, বন্ধ নালার থেকে যে ডেঙ্গি-সহ নানা রোগ ছড়ায়, তা অজানা নয়। জনস্বাস্থ্যের বিধি লঙ্ঘন করে যে সব সংস্থা, দোকান মালিক, বাজার কর্তৃপক্ষ, তাদের কাছে জবাবদিহি তলব করা, প্রয়োজনে শাস্তিবিধানের অধিকারও রয়েছে পুরসভার। কিন্তু প্রতি বছর কিছু নোটিস পাঠানো ছাড়া তেমন কিছু করে না পুরসভা। এবং সেটুকু তৎপরতাও দেখা যায়, যখন ডেঙ্গির প্রকোপ চরমে ওঠে। মাইকে প্রচার, ফ্লেক্স টাঙানো, কীটনাশকের প্রয়োগ, এ সবই শুরু হয় সংক্রমণ ছড়ানোর পরে। যে কোনও পতঙ্গ বা প্রাণী-বাহী রোগের প্রতিরোধ সম্বৎসরের কার্যসূচি, তা জানা সত্ত্বেও সে ব্যবস্থাকে খুব সামান্যই গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার ফলে প্রায় প্রতি বছরই কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনার কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় ডেঙ্গি প্রায় মহামারির রূপ নেয়, অকালে কেড়ে নেয় বেশ কিছু প্রাণ। এমন ব্যর্থতার মুখেও পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতরের তরফে প্রতি বারই চেষ্টা চলে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্যকে দায়ী করতে। সচেতনতার বার্তা প্রচার করার জন্য পাড়ার ক্লাবগুলিকে টাকা বিলি করতে দেখা যায়।
পাশাপাশি, তথ্য গোপনের চেষ্টাটিই বর্তমান শাসনে সবচেয়ে সুচারু ভাবে পরিচালিত হয়। প্রশাসনে স্বচ্ছতা প্রতিরোধ করতে ভীতিপ্রদর্শনের একটা জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যব্যাপী। সরকারি হাসপাতাল, সরকারি চিকিৎসক, স্বাস্থ্য আধিকারিক, রক্ত পরীক্ষার ল্যাবরেটরি— সব প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে, তথ্য প্রকাশের কী মূল্য চোকাতে হতে পারে। ডেঙ্গি সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশিত হলে সিআইডি তদন্ত হবে জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকদের বিরুদ্ধে, কয়েক মাস আগে এমনও ভয় দেখিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরা। অর্থাৎ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের থেকে ভয় দেখানোর বন্দোবস্তই বেশি। এ দিকে যাঁরা ডেঙ্গি রুখতে ব্যর্থ, এমনকি ডেঙ্গির তথ্য সরবরাহ করতেও ব্যর্থ, তাঁদের ভয়ই বা দেখাবে কে, মূল্যায়নই বা কে করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy