—প্রতীকী ছবি।
ভারতীয়করণ: শব্দটি রীতিমতো জোরদার। আবেগগত দিকেও তার জোর, প্রয়োগগত দিকেও। কোনও কিছুকে মূলগত ভাবে ভারতীয় বললে তার যে আবেগগত গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়, সেটাই তার প্রয়োগ-ক্ষেত্রের অবাধ স্বীকৃতি তৈরি করে। এই জন্যেই নব-প্রবর্তিত ভারতীয় ন্যায় সংহিতাকে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির অনুষঙ্গ থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। কথাটি আরও স্পষ্ট হল, যখন বিরোধীদের তীব্র সমালোচনার উত্তরে, গত এনডিএ মন্ত্রিসভা এবং বর্তমান এনডিএ মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জোর গলায় বললেন: এই নববিধান কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য— আইনের ভারতীয়করণ। আগেকার ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ ব্রিটিশ আইনের ছায়ায় তৈরি হয়েছিল, এ বার তা সত্যিকারের অর্থে ‘ভারতীয়’ হল। এই ভাবে ‘জাতীয়’ পরিচয়কে পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলার প্রচেষ্টা— এরই অমোঘ চিহ্নক ‘সংহিতা’ শব্দটি। এবং এরই জন্য, শাসক দলের কাছে নতুন আইনবিধির যে কোনও সমালোচনার বিরুদ্ধেই একটি হাতে-গরম কবচ প্রস্তুত— তাঁরা নাকি পুরনো ঔপনিবেশিক মডেল থেকে ‘ভারত’কে উদ্ধার করছেন। বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা জরুরি। কেননা, পুরনো ভারতীয় আইনবিধির বিরুদ্ধে তার যথেষ্ট ‘ডিকলোনাইজ়েশন’ করা হয়নি, এ ছাড়াও অনেক সমালোচনা ছিল। সেই বাঞ্ছিত পরিবর্তনগুলি আদৌ হল কি না, সেটা দেখার জন্যই অতিরিক্ত জাতীয়তাবাদ এবং বি-উপনিবেশীকরণ ইত্যাদি ‘ন্যারেটিভ’ বা আখ্যান থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।
পুরনো আইনের বিরুদ্ধে অন্যতম সমালোচনা ছিল, নাগরিকের উপর রাষ্ট্রের অতিরিক্ত কর্তৃত্ব। কেবল রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নয়, ইউএপিএ নয়, সন্ত্রাসবিরোধিতার আইন নয়, সাধারণ শৃঙ্খলারক্ষাকারী আইনের বিরুদ্ধেও নাগরিক অধিকার দলনের অভিযোগ উঠেছে। অথচ নতুন ‘সংহিতা’য় সে দিকে কোনও পরিবর্তন হয়নি, বরং পুলিশের অধিকার অনেক দিক দিয়ে বাড়ানো হয়েছে। ইউএপিএ-র মতো সরাসরি দমনমূলক আইন প্রায় সামগ্রিক ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘অর্গানাইজ়ড ক্রাইম’-এর চৌহদ্দি বাড়ানো হয়েছে সাইবার-ক্রাইমের মতো বিষয়ে কড়া শাস্তির কথা প্রত্যক্ষত অন্তর্ভুক্ত করে। আগে যেমন গ্রেফতারের পর কাউকে পুলিশ হেফাজতে ১৫ দিন পর্যন্ত রাখা যেত, ন্যায় সংহিতা অনুসারে সেই সময়সীমা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯০ দিন! এ সবের ভিত্তিতে বলাই যায়, প্রথমত, নতুন আইন আরও বেশি ‘ঔপনিবেশিক’— কেননা আরও বেশি অধিকারদলন-কারী। দ্বিতীয়ত, মৌলিক সমস্যাগুলির সুরাহা না করে যদি এই ধরনের পরিবর্তনই লক্ষ্য ছিল, তার জন্য সংশোধনী আনাই যথেষ্ট ছিল, নতুন আইনবিধি তৈরির দরকার ছিল না। তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ‘ভারতীয়করণ’ বলতে কি এনডিএ সরকার অধিকতর রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ বোঝাতে চায়?
সুতরাং, ন্যায় সংহিতা প্রযুক্ত হয়ে গেলেও তাকে নিয়ে বিতর্ক থামেনি, থামার কারণও নেই। এমনিতেই গত মন্ত্রিসভায় এই প্রস্তাব পাশ করানো হয়েছিল— বিরোধীদের কথায় কর্ণপাত না করে, কেবল সংখ্যাগুরুর গায়ের জোরে। সংসদে বিজেপির এমনিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, আইন পাশ হতই। কিন্তু লক্ষণীয়, বিরোধীদের সমালোচনার ভূমিটিও কেড়ে নেওয়া হয়, ওই সময়ে ১৪৬ জন বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে যথাযথই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী সংবিধানকে মান্য করার ‘ভান করেন’, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়মগুলিও মেনে চলেন না। নতুন সংহিতা-র ‘ন্যায়’ একমাত্র তখনই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যখন তা সঠিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সন্তোষজনক ভাবে গৃহীত হবে। নতুবা, নতুন আইন ‘ভারতীয়’ হোক না হোক, তার মাধ্যমে ‘ন্যায়’-প্রতিষ্ঠার দাবিটি প্রশ্নাতীত নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy