১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যখন ভারতের নিয়তির অভিসারে যাওয়ার কথা ঘোষণা করছিলেন, তখনই পূর্বজন্মের নাড়ি কেটে জন্মাল পশ্চিমবঙ্গ নামক অস্তিত্বটি— যার ইতিহাস অখণ্ড, কিন্তু ভূগোল খণ্ডিত। পরবর্তী পঁচাত্তর বছর সেই জন্মদাগ বহন করেছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের অর্থনীতিতেও যা ঘটেছে, তা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়েছে জন্মমুহূর্তের ঘটনাক্রমের দ্বারা। তার একটি অংশ বহুচর্চিত, দেশভাগ হওয়ার ফলে বাংলার অন্যতম প্রধান শিল্প চটশিল্পের বিপুল ক্ষতি হল। চটকলগুলি থাকল পশ্চিমবঙ্গে, হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে; পাট উৎপাদক অঞ্চলের সিংহভাগ চলে গেল পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু, সেটাই একমাত্র ক্ষতি নয়। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাপকাঠিতে অবিভক্ত বাংলা দেশের সর্বাগ্রগণ্য প্রদেশ ছিল। ক্রমে এই রাজ্যের অর্থনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পেতে আরম্ভ করল, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের সদর দফতর সরিয়ে নিল কলকাতা থেকে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক— দেশভাগের ফলে যে বিপুল জনসংখ্যা উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে নতুন ঠিকানা খুঁজে নিল, সেই শ্রমশক্তিকে ব্যবহার করে কি রাজ্যের নতুন শিল্পসম্ভাবনা তৈরি করা যেত না? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল, উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই যে-হেতু আজীবন অ-শিল্পক্ষেত্রে নিযুক্ত ছিলেন, তাই তাঁদের শিল্পে নিয়োগ করা কঠিন ছিল। উত্তরটি অসম্পূর্ণ। শিল্পক্ষেত্রে না হোক, অন্য কোনও ভাবে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের মাধ্যমে উদ্বাস্তু সমস্যার যে একটি দীর্ঘমেয়াদি, স্থায়ী সমাধানসূত্র নির্মাণ করা প্রয়োজন, নেহরুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এই কথাটি স্বীকার করতে চায়নি। সমস্যাটি সাময়িক, পরিস্থিতি শান্ত হলেই উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবেন পুরনো ঠিকানায়, এমন একটি অলীক বিশ্বাস পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যার প্রকৃষ্ট সমাধান করতে দেয়নি।
দেশভাগের জন্মদাগই আবার খুলে দিল এক নতুন পথ। নতুন ঠিকানায় কোনও ক্রমে থিতু হতে চাওয়া উদ্বাস্তু পরিবারগুলি বুঝতে পারল, বাঁচতে গেলে লড়তে হবে সবাই মিলে। চাকরির খোঁজে মেয়েরা পথে নামলেন। অফিসপাড়ায় ধুতি-পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্টের একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে এক জন-দু’জন করে দেখা মিলতে লাগল শাড়িপরিহিতার। রাস্তাঘাট, বাস-ট্রাম ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে উঠল কর্মরত মহিলাদের উপস্থিতিতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অন্তত প্রথম পর্বে ঘটনাটি ঘটেছিল মূলত উচ্চবর্ণের পরিবারে, যেখানে নারীশিক্ষার চল পূর্ব থেকেই ছিল। কিন্তু, নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে শুধু সেটুকুও বিপুল প্রভাব ফেলেছে। কার্যত গোটা দেশের থেকে পশ্চিমবঙ্গকে পৃথক করেছিল মহিলা কর্মশক্তি। অন্য একটি ঘটনাও ঘটেছিল এই একই সময়ে, তারও সুদূরপ্রসারী ফল প্রত্যক্ষ করেছে পশ্চিমবঙ্গ— দেশভাগ-পরবর্তী বঙ্গে বাম রাজনীতির পায়ের নীচে জমি ক্রমেই শক্ত হয়েছে। উদ্বাস্তু কলোনির সংগঠন থেকে খাদ্য আন্দোলন, কলকারখানায় শ্রমিক আন্দোলন— প্রতিটি ক্ষেত্রেই উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী এবং বাম রাজনীতি একে অপরের সম্পূরক ভূমিকা পালন করেছে। তাতে এক দিকে এই রাজ্যের রাজনৈতিক ভাষ্যের অন্তত উপরিভাগে ধর্ম বা জাতির মতো প্রশ্নগুলি বহু দিন অবধি ঠাঁই পায়নি। আবার অন্য দিকে, বাম রাজনীতি ক্রমেই শিল্পবিরোধী জঙ্গি অবস্থান নিয়েছে, ফলে পশ্চিমবঙ্গ পরিণত হয়েছে শিল্পশ্মশানে।
পঁচাত্তর বছরের পরিক্রমা শেষে পশ্চিমবঙ্গ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে উদ্বেগ অস্বাভাবিক নয়। বৃহৎ শিল্প এই রাজ্যের কপালে সোনার কাঠি ছোঁয়ায়নি, অন্য দিকে রাজনীতিতে ক্রমে অ-ধর্মনিরপেক্ষ বিভাজিকাগুলি প্রকট হয়ে উঠেছে। রাজ্যবাসী সরকারি দানসত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন, আর রাজনৈতিক শ্রেণি তাঁদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তা থেকে খাজনা আদায় করাকেই মোক্ষ ঠাওরেছে। স্বাধীন ভারতের পৌনে শতকের যাত্রায় পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই পিছিয়েছে। তার শিক্ষার অহঙ্কার গিয়েছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রের নাভিশ্বাস উঠেছে। উচ্চশিক্ষিত থেকে স্কুলছুট, সবাই এখন কাজের সন্ধানে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেয়। বিপন্নতা থেকেও যে নতুন সম্ভাবনা জন্মাতে পারে, রাজ্যের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস একাধিক বার সেই সাক্ষ্য দিয়েছে। প্রশ্ন হল, আবারও কি পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব? হতোদ্যম রাজ্যটির সামনে কোনও আশার আলো আছে কি? শাসক দলকে যেমন এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হবে, তেমনই করতে হবে বিরোধীদেরও। নাগরিক সমাজকেও। সকলকেই হয়ে উঠতে হবে রাজ্যের উন্নয়নের যোগ্য ভাগীদার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy