কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রী কিরেন রিজিজু । ফাইল ছবি।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তনের কোনও পরিকল্পনা সরকারের আছে কি? সম্প্রতি এই প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রী কিরেন রিজিজু সংসদে জানিয়েছেন, বিষয়টি এখন ২২তম আইন কমিশনের বিবেচনাধীন। এই বক্তব্যকে সদুত্তর হিসাবে মেনে নেওয়ার বাধা এই যে, নাগরিক এখন অবগত, বর্তমান শাসকবর্গের কাছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার। জনসঙ্ঘের যুগ থেকেই তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির তালিকায় এই বিষয়টিকে স্থান দেওয়া হয়েছে, ক্রমে এটি সেই তালিকায় তিনটি প্রধান দাবির অন্যতম হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারে বিজেপি আইন কমিশনকে এ-বিষয়ে প্রস্তুতির ভার দেওয়ার কথা বলেছিল। সংসদে বারংবার— গত ডিসেম্বরেও এক বার— এই উদ্দেশ্যে ‘বেসরকারি সদস্যের বিল’ আনা(নো) হয়। অতি সম্প্রতি কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এক কার্যকর্তা প্রায় একই ভাষায় এই বিধি প্রবর্তনকে সংবিধানের অন্তরের নির্দেশ বলে ঘোষণা করেছেন। এবং, ঠিক এই সময়েই, কেন্দ্রীয় সরকার ২২তম আইন কমিশনের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছে আগামী বছরের অগস্ট অবধি, অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচনের নির্ধারিত সময়ের পরে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তনের পক্ষে সওয়াল এবং তার অনুসারী তৎপরতাও সম্ভবত ততই বাড়বে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে নিছক সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক প্রকরণ বলে গণ্য করলে ইতিহাস ও বাস্তবের প্রতি অবিচার করা হবে। একটি উদার আধুনিক সমাজে বিবাহ, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ, সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা, ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে ধর্ম-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিককে একই আইনের আওতায় নিয়ে আসার পক্ষে জোরদার যুক্তি আছে। বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ আইন বা জীবনচর্যার স্বতন্ত্র বিধান ব্যক্তিসত্তার সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে। ভারতীয় সংবিধান ব্যক্তিকে তার আদর্শগত ভিত্তিমূলে স্থান দিয়েছে— সংবিধানের রচনাপর্বে যাঁরা গোষ্ঠী বা কৌমের অধিকারকে ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, প্রবল প্রতিযুক্তির সাহায্যে তাঁদের সেই মত খণ্ডন করা হয়েছিল। পরবর্তী সাত দশকেও এই প্রশ্নে বহু তর্ক হয়েছে। প্রতিযুক্তি নিছক ব্যক্তি-স্বাধীনতার নয়, ‘জাস্টিস’ বা ন্যায্যতারও। বিশেষত একটি গোষ্ঠীর কৌম-অধিকার অনেক ক্ষেত্রে তার সুযোগবঞ্চিত বা দুর্বলতর অংশের অধিকার হরণ করে। ‘তিন তালাক’ নামক বিবাহবিচ্ছেদের রীতিটি তার এক উৎকট নজির। এই ধরনের গোষ্ঠীগত আধিপত্য নির্মূল করার উদ্দেশ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রয়োজন আছে। ধর্মনিরপেক্ষ, বহুসংস্কৃতিবাদী উদার গণতন্ত্রের আদর্শটির অপব্যবহার অবশ্যই আপত্তিকর।
কিন্তু সেই আদর্শকে বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা আরও বেশি আপত্তিকর। গণতন্ত্রের পোশাকে সংখ্যাগুরুতন্ত্রের চালকরা যদি মেরুকরণের রাজনীতির যথেচ্ছ প্রয়োগে জনমত উৎপাদন করে সংখ্যালঘুর উপর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চাপিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন, সেই তৎপরতা গণতন্ত্রের মর্মমূলে আঘাত করে। এ দেশের বর্তমান শাসকদের অভিধানে ‘অভিন্নতা’ শব্দটি একাধিপত্যের নামান্তর। কেবল সংখ্যালঘু নয়, সমস্ত গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য এবং বিভিন্নতা সেই লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা, সুতরাং জোর করে সেই বাধা অপসারণ করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। সংখ্যালঘু বা অন্যান্য গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ বৈষম্য দূর করে ব্যক্তির স্বাধীনতা-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সঙ্গে যে নিরন্তর কথোপকথনের প্রয়োজন ছিল, পূর্ববর্তী শাসকরা তা করেননি, এ তাঁদের মস্ত ত্রুটি। কিন্তু বর্তমান শাসকরা সেই কথোপকথনের প্রয়োজন স্বীকারই করেন না। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তাঁদের কাছে মেরুকরণের রাজনীতির একটি কৌশল, সংখ্যাগুরুতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি প্রকরণ। এই সত্য ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অতিমাত্রায় বিপজ্জনক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy