পৃথিবী যতই এগোয়, মানুষে মানুষে হিংসা ভাব ততই এক রকম থাকে। ছবি: রয়টার্স।
বিখ্যাত আমেরিকান সঙ্গীতকার-গায়ক পিট সিগার স্মৃতিচারণ করেছিলেন তাঁর জনপ্রিয় গান ‘হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন’ নিয়ে। ১৯৫৫ সালে প্রথম বার প্রকাশ্যে আসা গানটির অসামান্য পঙ্ক্তিগুলি নাকি তিনি পান একটি উপন্যাস থেকে। উনিশ শতকের রাশিয়ার ডন নদী-তীরবর্তী কসাক জাতির সেই কাহিনিতে কসাক সৈন্যদের কথা এ ভাবেই বলা ছিল, ‘কোথায় গেল ফুলগুলি? মেয়েরা তা তুলে নিল। কোথায় গেল মেয়েগুলি? তাদের বিয়ে হয়ে গেল। কোথায় তাদের স্বামীরা? তারা যুদ্ধে চলে গেল।’ এর থেকেই পিট সিগারের হাতে গেঁথে উঠেছিল যুদ্ধবিরোধী মানবিক জীবনের সুরতোলা সেই গান, বিশ্বজোড়া যার আবেদন। রাশিয়ার সেই ‘নেপোলিয়নিক’ যুদ্ধ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ইউরোপের ইতিহাসের। তার পরও যুদ্ধ থামেনি, জ়ার সাম্রাজ্যেও নয়, সোভিয়েট ইউনিয়নেও নয়। দুটো শতাব্দী ধরে লাগাতার যুদ্ধ দেখেছে তারা, সম্পূর্ণ ধ্বস্ত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে আশা করেছে, এ বার দিন পাল্টাবে। পরের দশকগুলিও সঙ্কট আর সংঘাতের মধ্যে কাটলেও একুশ শতকে এসে স্পষ্ট বোঝা গেল, না, দিন পাল্টানোর নয়। বাস্তবিক, ২০২২ সাল দেখল এক অপ্রত্যাশিত ও ভয়ানক যুদ্ধ— ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিনশো দিন ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার তীব্র আক্রমণ ও উত্তরে ইউক্রেনের প্রত্যাঘাত জারি রইল। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগে বিশেষজ্ঞ-মহল মনে করেছিল, ইউক্রেন সঙ্কট ঘোর পাকিয়ে উঠলেও ‘বড় যুদ্ধ’ হবে না। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহেও আমেরিকান, ব্রিটিশ, জার্মান গোয়েন্দা দফতরের খবর ছিল, রাশিয়া আক্রমণ শানাবে না। এ দিকে ২৪ ফেব্রুয়ারি সব পূর্বাভাস মিথ্যা করে রুশ বিমানহানা শুরু হল। একটা গোটা বছর জুড়ে ইউক্রেন ভূখণ্ডে সকলে ‘যুদ্ধে চলে গেল’, আর বিধ্বস্ত ছারখার হয়ে গেল একটা সুন্দর দেশ। মনে করিয়ে দিয়ে গেল, পৃথিবী যতই এগোয়, মানুষে মানুষে হিংসা ভাব ততই এক রকম থাকে।
সব যুদ্ধ রক্তে লেখা, কিন্তু সব যুদ্ধের লেখা এক নয়। সভ্যতার উপর সুগভীর, সুব্যাপ্ত প্রভাব রেখে যাওয়ার মতো যুদ্ধ হয় কয়েকটিই মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কম সংঘর্ষ দেখেনি পৃথিবী, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ যে দাগ রেখে যেতে চলেছে গোটা বিশ্বের সর্ব ক্ষেত্রে, তার তুল্য ঘটনা দুর্লভ। এ যুদ্ধ আদৌ ‘শেষ’ হবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। এক অনন্ত ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতেই থাকবে, বাকি বিশ্বকে সংক্রামিত করেই চলবে, এমন আশঙ্কার মধ্যেই আজ একটি নতুন বছরের সূচনা।
এই যুদ্ধের নেপথ্যে ঘটে চলেছে আরও বহুবিধ সংঘাত-প্রস্তুতি। সবাইকে স্তম্ভিত করে নিউক্লিয়ার যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। পাশাপাশি, গত এক বছরের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে যে পরিমাণ প্রতিরক্ষা-ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে রাশিয়া, আমেরিকা, জার্মানি, ইজ়রায়েলের মতো দেশ, তাতে অবশিষ্ট দুনিয়ার মহাশঙ্কার কারণ আছে। রাশিয়া এহ বাহ্য, কিন্তু অন্যান্য দেশও এ ভাবে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াচ্ছে, তার অর্থ কেবল প্রতিরক্ষার আয়োজন নয়, প্রয়োজনে আক্রমণ শানানোর সঙ্গতি রাখতেও বড় দেশগুলি সচেষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন ঘটনা বেশি ঘটেছে কি? বিশ্ব-অর্থনীতির মধ্যেও বড় ক্ষত তৈরি করতে চলেছে এই যুদ্ধ। রাশিয়ার খনিজ তৈল ও গ্যাস সম্ভারের দুয়ার বন্ধ হওয়ায় ইউরোপ জুড়ে জ্বালানি সঙ্কট, এবং পৃথিবী জুড়ে জ্বালানির মূল্যসঙ্কটে এখন আরও প্রমাদ গনছে ইউরোপের বহু দেশ। বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে এই প্রথম এত বিপদগ্রস্ত শীতকাল কাটাচ্ছে তারা, যার ফলে সামাজিক অস্থিতি এবং দক্ষিণপন্থা দ্রুত বাড়ার আশঙ্কা। অস্ত্র-গবেষণাতেও সম্প্রতি অত্যন্ত জোর পড়েছে, মধ্য-বিশ শতকের পর আবারও। উদ্বাস্তুদের কথা বহুশ্রুত, ইউরোপ রীতিমতো অশান্তির আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এক দিকে সিরিয়ান ও অন্য দিকে ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তু প্রবাহ নিয়ে। এই প্রথম ইউরোপের মানুষ দেখছে দলে দলে উদ্বাস্তু শ্বেতকায় খ্রিস্টান। বিশেষ বিপন্ন বোধ করছে তারা, কারণ অশ্বেতকায় উদ্বাস্তুকে শত্রুভাবে দূরে সরিয়ে রাখা সহজ, ‘নিজেদের মতো’ উদ্বাস্তুদের নয়। ‘অপরায়ণ’ বা আদারাইজ়েশন-এর নতুন ভাষার সন্ধান হয়তো-বা আসন্ন। হয়তো শ্বেত, অশ্বেত, দুই উদ্বাস্তু ‘জাতি’র মধ্যে সংঘর্ষ পরিস্থিতিও ঘনিয়ে উঠবে অচিরেই। সব িমলিয়ে নতুন বছরটি পৃথিবীকে নতুন দরজার সামনে নিয়ে এসেছে, যার বাইরে পুঞ্জীভূত সব ফুলেই হয়তো যুদ্ধের ঘ্রাণ। নিছক বর্ষবরণের শুভেচ্ছা বিনিময় করে সেই ঘ্রাণ দূর করা যাবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy