—প্রতীকী ছবি।
বছর শেষ হল। ‘শেষ’ বলতে অনেকে বোঝেন অন্ত। সংস্কৃতে ‘শেষ’ মানে অবশেষ— যা পড়ে থাকে। এই বিপরীত অর্থ মনে রাখলে ‘বর্ষশেষ’ কথাটি আরও লাগসই মনে হয়। বারো মাস, ছয় ঋতুতে যা কিছু পাওয়া গেল— কিছু অর্জিত, কিছু উপহার, কিছু বা পড়ে-পাওয়া চোদ্দো আনা— সে কি আর মিলিয়ে যেতে পারে রাতারাতি? নতুন খাতায় প্রথম দাগটিতে সে সব অলীক ধনসম্পদ অক্ষয় অক্ষরে ফুটে ওঠে। সে জন্যই না একের হিসাব অন্যের সঙ্গে মেলে না। যতই জয়ধ্বনি উঠুক অচেনার, শিশুর মতো দু’হাত বাড়িয়ে মন যতই খুঁজুক অজানার আনন্দ, অলক্ষ্যে হাত রাখে সম্বৎসরের শেষ সম্বল। কী সেই গোপন ধন, কী করে বুঝব? তাকে অনুভব করতে দরকার একটু সময়। বৎসরের প্রথম দিনের ছুটি হয়তো কেবল বর্ষবরণের উৎসব-স্ফূর্তির জন্য নয়। কাল ছুটি, এই আশ্বাসে বছর শেষের দিনটিতে নিজের মনকে একটু ফুরসত করে দেওয়াও তার উদ্দেশ্য। কালসাগর নিরবধি, বছর ঘুরে যাওয়া জলে দাগ টানা বই তো নয়। তবু চৈত্রের সংক্রান্তি যে সব বাঙালির কাছে বৎসরান্তের দিন— এক দিকে বারো মাস পূর্ণ হওয়ার স্বস্তি, আবার অন্য দিকে তাকে বিদায় দেওয়ার বেদনায় বিধুর— সে কথাটা সহস্র হৃদয়কে এক সূত্রে বেঁধে দেয় বইকি। তাই নববর্ষ যখন সৌজন্য-সৌহার্দ প্রকাশের দিন, বর্ষান্তে চৈত্রের শেষ দিনটি নাহয় হোক রিক্ততার নীরব যাপন।
হৃৎপিণ্ডের এক স্পন্দন থেকে অন্য স্পন্দন, সমুদ্রের এক ঢেউয়ের পরে আর এক ঢেউ, তালের অন্তিম মাত্রার ছুঁয়ে এসে সম— তেমনই বছর গিয়ে বছর শুরুর মাঝে কিছু নিমেষ-মুহূর্ত হাতে রয়েছে শুধু। যা কিছু চিনেশুনে, গুণেগেঁথে নেওয়ার, নিতে হবে তারই মধ্যে। বছরের সঞ্চয়ের একটা অভিমুখ বাইরে থেকে ভিতরের দিকে। রসিক সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, দুটো জিনিস ঈশ্বর এখনও কেড়ে নেননি বাঙালির থেকে, বাঙালি মেয়ের উলবোনা আর বাঙালির হাসি। পশ্চিমবঙ্গের স্টেট জিডিপি যা-ই হোক, হাসির হররা দিয়ে ‘হ্যাপিনেস কোশেন্ট’ মাপলে বাঙালির হারানোর কিছুই নেই, অম্বলের ওষুধ ছাড়া। হাসির ক্ষমতা নেহাত হাসির কথা নয়— যাঁরা উমবের্তো একো-র নেম অব দ্য রোজ় উপন্যাসটি পড়েছেন, তাঁরা জানেন যে স্বৈরতন্ত্রের কাছা টেনে খোলার পথ হাসির দমক। বাঙালির হাস্যপ্রতিভা আগের চেয়ে বেশি দরকার। হাসির পরেই আসে খাওয়াদাওয়া— সেখানেও বাঙালি স্বস্থিত। অর্থাৎ একই সঙ্গে ঐতিহ্য-বিলাসী আর সুদূরের পিয়াসী। তাই এক দিকে বিজয়ার পাটিসাপটা থেকে জন্মাষ্টমীর তালের বড়া, সবই মিলছে দোকানে। অন্য দিকে ছড়াচ্ছে ‘কাফে কালচার।’ মহানগর থেকে আধা-শহর, কাফের পসরা লেবানন থেকে কোরিয়া ছুঁয়ে পেরু, কোথায় না গিয়েছে। এ বছর দেখল নতুন কত বই প্রকাশক, নবীন চিত্রপরিচালক, ধ্রুপদী সঙ্গীত-নৃত্যের তরুণ শিল্পীকে। বাংলার তাঁতির বয়নে, সূচিশিল্পীর নকশায় কত অভিনব চিন্তা, মণ্ডপসজ্জায় নান্দনিক চেতনার নব নব প্রকাশ। এই সৃষ্টিসুখের উল্লাসকে সামান্য বলে দেখা যাবে না, এর মধ্যে তরুণ বাঙালির প্রাণশক্তিরই পরিচয়।
আর অন্তরের সঞ্চয়? ‘ওই যায়, চলে যায় কালপরপারে/ মোর পুরাতন।/ এই বেলা, ওরে মন, বল্ অশ্রুধারে/ কৃতজ্ঞ বচন।’ (‘নববর্ষে’, ১৩০১) নানা ঝাঁঝালো আবেগ যখন জনজীবনের রস নির্ণয় করছে, তখন বছর তেত্রিশের রবীন্দ্রনাথের এমন বিনম্র কৃতজ্ঞতা যেন খাপছাড়া, অ-লৌকিক মনে হয়। অথচ, এ-ও বাঙালিরই স্বভাব। পৃথিবীর ঘ্রাণের পসরা, ঝরা শিশিরের গান যার কবির সর্বোত্তম পার্থিব সম্পদ, যা তাঁকে টেনে আনে এমনকি পরপার থেকে, সে জাতি কি নিজেকে আঁটাতে পারে অভাব-বিক্ষোভের ফ্রেমে? বাইরের দুর্বিপাকে যতই মথিত-উন্মত্ত হোক বাঙালির চিত্ত, মনের গহনে বাজা অশ্রুত বাঁশিটি বছর থেকে বছরে সুর বেঁধে দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy