অতিমারি-আক্রান্ত দুনিয়াতেও বাগদান অঙ্গুরীয়ের মহিমা অম্লান। সংবাদে প্রকাশ, সম্প্রতি লন্ডনের এক হ্রদের তীরে ভারতীয় বংশোদ্ভূত দুই তরুণ-তরুণী হাজির হইয়াছিলেন। দুই জনেই পরস্পরের সহিত বাগদানের অঙ্গীকারে আবদ্ধ, হ্রদের ধারে যুগল ছবি তোলাইতে গিয়াছিলেন। অতঃপর, বাগদানের হীরকখচিত অঙ্গুরীয়টি সহসা তরুণীর অনামিকা হইতে হ্রদের জলে খসিয়া পড়ে। তরুণের শত চেষ্টাতেও উহা উদ্ধার করা যায় নাই; শেষে এক ডুবসাঁতারু কয়েক ঘণ্টার অভিযানশেষে সেই অভিজ্ঞান উদ্ধার করেন। এই আপাততুচ্ছ সংবাদে কেহ বাগদান-অঙ্গুরীয় ও তজ্জনিত সংস্কারের মুণ্ডপাত করিতে পারেন; কাহারও বা কালিদাসের নায়িকা শকুন্তলার আংটি হারাইবার কথা মনে পড়িতে পারে। কোনও বাঙালি বঙ্কিমচন্দ্রের যুগলাঙ্গুরীয় উপন্যাসের কথা মনে করিতে পারেন; রামভক্ত হইলে অশোকবনে সীতাকে হনুমান কী ভাবে রামচন্দ্রের আংটি দেখাইয়া নিজেকে শ্রীরামের দূত প্রমাণ করিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করিয়া আপ্লুত হইতে পারেন। শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে আদালতে কুসীদজীবী শাইলক পরাস্ত হয়, তবু নাটক অপেক্ষায় থাকে শেষের মোক্ষম আংটিমুহূর্তের জন্য। নায়িকা পোর্শিয়া স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে তাহার আঙুল আংটিহীন কেন! স্বামী জানায়, আদালতের আইনজীবীকে সেটি দিতে বাধ্য হইয়াছে সে। পোর্শিয়া বলে, নিজের শপথ ও সম্মানের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান থাকিলে ওই আংটি তুমি অন্যকে দিতে না। এমনকি বিবাহের আংটির সহিত দাম্পত্য সহবাসও একাকার হইয়া যায় পোর্শিয়ার সংলাপে— আংটি না দেখাইলে আমি তোমার সহিত এক শয্যায় আর নাই। আংটিই পার্সোনাল তথা পলিটিক্যাল ক্ষমতার উৎস।
কেহ প্রশ্ন তুলিতে পারেন, স্বর্ণনির্মিত অঙ্গুরীয় ক্রয়ের ক্ষমতা যাহার নাই, তাহার কী হইবে! অঙ্গুরীয়ের প্রচলন নাই বলিয়া কি আদিম জনজাতির বিবাহপ্রথা নিরর্থক! এই সকল কূটতর্ক সরাইয়া রাখিলে দেখা যাইবে, অঙ্গুরীয়ের সৌন্দর্য অন্যত্র। স্বর্ণাঙ্গুরীয় প্রথম নির্মাণ করেন গ্রিকরা। অর্থাৎ, যবনরা এই দেশে পদার্পণ না করিলে সীতা হইতে শকুন্তলা, কাহারও আংটি জুটিত না। গির্জা বা মণ্ডপ, যেখানেই বিবাহ হউক না কেন, যাঁহাকে সাক্ষী রাখিয়াই দাম্পত্য অঙ্গীকার করা হউক না কেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহ বা লিভ-ইন বা যাহাই হউক, আংটিদানে বিধিনিষেধ নাই। ইংল্যান্ডের ভাবী রানি কেট মিডলটনের অঙ্গুরীয়টি তাঁহার শ্বশ্রূমাতা লেডি ডায়ানার স্মৃতিজড়িত। আংটি হারাইলে দুর্বাসার অভিশাপে দুষ্মন্ত প্রেয়সী শকুন্তলার স্মৃতি ভুলিয়া যান। কালিদাসের শকুন্তলা, শেক্সপিয়রের পোর্শিয়া হইতে আজিকার কেট, সকলের অঙ্গুরীয়ই দাম্পত্যের পরিসরে নারীর ক্ষমতার চিহ্নক। হার, বালা বা রতনচূড় নহে, আংটির সঙ্কেত যুগে যুগে জনসংস্কৃতিতে নানা ভাবে ফিরিয়া আসে। প্রচলিত কমিক্সে অরণ্যদেব শত্রুর গালে সজোর ঘুষিতে তাঁহার আংটির খুলির ছাপ আঁকিয়া দেন। এহেন আমেরিকান কমিক্সের পূর্বে ইংল্যান্ডে টোকিয়েনের বিখ্যাত দ্য লর্ড অব দ্য রিংস নামক কল্পকাহিনির অভিযানও শক্তিশালী আংটির সন্ধান লইয়া। সেই আংটিতে মধ্য দুনিয়ার কল্পিত মনুষ্য, ভূত, বামন ও অন্য সকল জীবের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করা যায়। আংটির জন্যই সেখানে দেশে দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কয়েক সহস্রাব্দ পর এক জন সেই আংটির সন্ধান পায়, কিন্তু ওই আংটির কবলে কয়েক শতাব্দী কাটাইয়া সে ‘গোলাম’ নামক এক অদ্ভুতদর্শন জীবে পরিণত হয়। অলৌকিক আংটি তৈরির প্রক্রিয়ায় যে জড়িত থাকে, কালক্রমে সে-ই উহা ব্যবহার করিয়া অন্যদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করিতে চাহে। ইহার সহিত আজিকার মোদী, বোলসোনারো, এর্দোয়ান-অধ্যুষিত গণতন্ত্রের তুলনা টানা মানুষী ইচ্ছা। প্রকৃত প্রস্তাবে, ইহা হিটলারের নাৎসিবিদ্বেষ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কল্পিত ভুবন লইয়া অক্সফোর্ডের অধ্যাপক টোকিয়েনের লেখা কাহিনিমাত্র!
অভিনেত্রী এলিজ়াবেথ টেলর এক বার বলিয়াছিলেন, তাঁহার সংগ্রহের প্রতিটি অলঙ্কারই এক-একটি পৃথক গল্প। কোভিডকালে লন্ডনের হ্রদে যে সাঁতারু ওই আংটি উদ্ধার করিয়াছেন, তিনি এক পরিবেশকর্মী। প্রেমিকযুগলের হইতে ব্যক্তিগত পারিশ্রমিক লন নাই, হ্রদের পরিবেশরক্ষার্থে তাঁহাদের সংগঠনের জন্য দান চাহিয়াছেন। শকুন্তলা, পোর্শিয়ার কাহিনি তাঁহাদের যুগের। এই যুগের আংটিকাহিনি যে অন্য রকম হইবে, পরিশেষে অঘটনের পরিবর্তে পরিবেশ রক্ষা আসিবে, তাহাই স্বাভাবিক। প্রতিটি যুগের আংটি-কাহিনিতেই নিজস্ব সময়সংস্কৃতির কারুকাজ থাকিয়া যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy