Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Education

চক্ষুরুন্মীলিতং যেন

‘শিক্ষা বাজারের দখলে চলে গেছে’ কিংবা ‘পুরো পরিস্থিতিই রাজনীতির শিকার’ ইত্যাদি অজুহাতে নিজেদের দোষ ক্ষালন করে লাভ নেই।

শিক্ষার হাল।

শিক্ষার হাল।

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:৪০
Share: Save:

বছর তিনেক আগেও সেপ্টেম্বরের শুরুতে গর্বিত বাঙালির সমাজমাধ্যম একটি কূটতর্কে ভেসে যেত। রাধাকৃষ্ণন নয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনই হোক শিক্ষকদিবস। এখন ভাবী শিক্ষকরা ধর্মতলায় অনশনে বসেন, আদালতের নির্দেশে জাল-জোচ্চুরির জন্য কিছু শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে, শিক্ষকতার সার্ভিস কমিশন নাকি ঘুষ ও দুর্নীতির পাঁকে আকণ্ঠ ডুবুডুবু। ভারতীয় রাজনীতিতে হয়তো এটি ব্যতিক্রম নয়, অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারির কথা অনেকের মনে পড়তে পারে। কিন্তু রাজনীতি, সাম্প্রতিক ঘটনার সালতামামি কিছুই বাঙালিকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। রাধাকৃষ্ণন থেকে বিদ্যাসাগর, বুনো রামনাথ, সকলের নামের অধিকার আমরা হারিয়েছি। এ বিষয়ে চড়াম চড়াম গলাবাজি করে বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ কারও শরণাপন্ন হয়ে লাভ নেই। দু’জনেই শিক্ষক ছিলেন। কেউ মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে, কেউ বা শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ে।

হাল এই রকম হল কেন? ‘শিক্ষা বাজারের দখলে চলে গেছে’ কিংবা ‘পুরো পরিস্থিতিই রাজনীতির শিকার’ ইত্যাদি অজুহাতে নিজেদের দোষ ক্ষালন করে লাভ নেই। শিক্ষক কে? যিনি ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠ্যসূচি নিয়ে মুখের ফেনা উঠিয়ে দেন ও পরীক্ষা নেন? তা হলে ‘শিক্ষাষ্টক’ রচয়িতা শ্রীচৈতন্য কোনও দিন শিক্ষক ছিলেন না। তিনি টোলে পুঁথি পড়া যত না শিখিয়েছেন, তার চেয়ে সঙ্কীর্তন অনেক বেশি। শিক্ষাবিজ্ঞানের আধুনিক ধারণায় ইংরেজি ‘টিচার’ থেকে বাংলা ‘শিক্ষক’ সবই এখন অতীত। শিক্ষক তিনিই, যিনি কোনও কাজকে সহজবোধ্য করে তুলবেন। গালভরা ইংরেজি শব্দ, ফেসিলিটেটর। বাংলায় কাজ চালানোর জন্য বলা যায় সহজ করার সহযোগী, সংক্ষেপে— সহায়ক। কোনও প্রবীণ যদি পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বেঞ্চে বসা কাউকে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বোঝান, তিনি এক জন সহায়ক। আবার ওই একই বিষয় যদি কোনও সহপাঠী চমৎকার বুঝিয়ে দেয়, সে-ও তখন সহায়ক। এই শিক্ষক মুখে বোঝাতে পারেন, আবার কম্পিউটার, ছবি, মানচিত্র, ইউটিউবে গান ইত্যাদি উপকরণও ব্যবহার করতে পারেন। শিক্ষার্থীর কাজটা সহজ করে দিচ্ছেন বলেই তিনি ফেসিলিটেটর। খাওয়াদাওয়া, পুষ্টির কাজটাও তিনি সহজে করে দেবেন বলেই তো সহায়ককে মনের মধ্যে কোনও অসন্তোষ না পুষে মিড-ডে মিলে নজরদারি বজায় রাখতে হবে। শিক্ষককে সহায়ক হিসেবে ভাবলে অনেক সমস্যা মিটে যাবে। তখন শিক্ষক অবসর সময়ে সুইমিং কস্টিউম পরে ইনস্টাগ্রামে ছবি দিয়েছেন কেন, তা নিয়ে বাবা, ছেলে, প্রতিষ্ঠান কারও কোনও ক্ষোভ থাকবে না।

বস্তুত, সহায়কের কাজ আরও পরিব্যাপ্ত। শিক্ষক পোডিয়াম থেকে হোসপাইপের মতো জ্ঞানের স্রোতোধারায় ছাত্রকে স্নান করিয়ে দেবেন, এই ধারণাতেও আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান বিশ্বাসী নয়। টিভি, সিনেমা দেখে, খেলার মাঠে বা আত্মীয়মহলে সব সময় কোনও না কোনও জ্ঞান অর্জিত হয়। সহায়ক সমাজ-বাস্তবতার আলোয় আমার সেই অগঠিত, অপরিণত জ্ঞানের বদলে নতুন পূর্ণতা দেবেন। রামায়ণ যে মুখে মুখে কয়েক শতক ছড়িয়েছে, গুপ্তযুগে সেটি সঙ্কলিত হয়, বাংলা রামায়ণই সব নয়, হিন্দি, তামিল ভাষাতেও আছে, সেই জ্ঞান তো সহায়কই সঞ্চারিত করবেন। এটাই শিক্ষকের কাজ। গোলাপ, টিচার বা ফেসিলিটেটর, যে নামেই তাকে ডাকো না কেন! তবে অতিমারি অনেক ধারণা বদলে দিয়েছে। গত করোনাকালে ক্লাসরুম ছিল না, পোডিয়াম ছিল না। কিন্তু অনলাইন ক্লাসে, মোবাইলের উল্টো দিকে সহায়ক ঠিক ভেসে উঠতেন। শ্রেণিকক্ষ থাকুক বা না থাকুক, পড়ুয়া থাকলে শিক্ষক অবশ্যই থাকবেন। এখানেই তাঁর অপরিহার্যতা। প্রাচীন আথেন্সে কোনও স্কুল ছিল না। সোক্রাতেসের শিক্ষায় কুস্তির আখড়া বা জিমনাসিয়াম থেকে প্লাতো, আরিস্ততলের মতো ছাত্রের জন্ম। ঠাকুর রামকৃষ্ণ কোনও পাঠশালার পণ্ডিত ছিলেন না, কিন্তু তিনি যখন সহজ ভাষায় মান আর হুঁশ দুটো মিলিয়ে মানুষের কথা বলেন, তিনি তো আসলে এক জন ফেসিলিটেটর। এই শিক্ষক দিবসে প্রণিপাত করে, সেবা দিয়ে শিক্ষককে আকাশে তোলার দরকার নেই। বরং তাঁকে সহায়কের মর্যাদাটুকু দেওয়া হোক, আর ছাত্রছাত্রী ও সহনাগরিকদের শিক্ষায় যথার্থ সহযোগী হয়ে ওঠার পরিবেশটা বজায় রাখা হোক। নইলে পুরো সংস্কৃতিই রসাতলে যাবে। প্রশ্ন, পরিপ্রশ্নের কেউ থাকবেন না— কী অফলাইনে, কী অনলাইনে।

অন্য বিষয়গুলি:

Education Teachers Education Sector
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy