Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Rabindranath Tagore

মঙ্গলালোকে

রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভূমি যেখানে এসে পৌঁছেছে সেখানে প্রতিনিয়ত জীবনের সর্বস্তরে অসংযম, অকল্যাণ এবং অসুন্দরের উৎকট রাজত্ব চলছে।

An image of Rabindranath Tagore

পঁচিশে বৈশাখ অতিক্রান্ত হওয়ার পরে, কবিপক্ষের অনুষ্ঠানগুলি অতীত হওয়ার পরে বাঙালির চিন্তাভাবনার ভুবনে রবীন্দ্রনাথ কতটুকু জেগে থাকেন? ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৩ ০৫:৪১
Share: Save:

আর দু’দিন পরে পঁচিশে বৈশাখ। বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিকই অনন্য, তাঁর জন্মদিন কাছে এলে তাই আজও মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে যে রোমাঞ্চ জাগে, সংবেদনশীল মনে তার অনুরণন নির্ভুল ভাবে ধরা পড়ে। কিন্তু তার পরে? সেই অনুভূতি তাঁর স্বভূমির নাগরিকদের জীবনে ও চেতনায় কতখানি সঞ্চারিত হয়? পঁচিশে বৈশাখ অতিক্রান্ত হওয়ার পরে, কবিপক্ষের অনুষ্ঠানগুলি অতীত হওয়ার পরে বাঙালির চিন্তাভাবনার ভুবনে রবীন্দ্রনাথ কতটুকু জেগে থাকেন? এ-কথা মনে করার, এবং মনে করে বিষণ্ণ বোধ করার, যথেষ্ট কারণ আছে যে তাঁর জন্মদিনটি এই সমাজের এক বিপুল অংশের কাছে আজ কেবল একটি উপলক্ষ, তার বেশি কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই বিষাদের শরিক হতেন, নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য, উত্তরসূরিদের জন্য। একশো বছরেরও বেশি আগে, ১৩১৩ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে রচিত ‘সৌন্দর্যবোধ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, উপলক্ষের দ্বারা লক্ষ্য প্রায়ই চাপা পড়ে; সে গান শিখিতে চায়, ওস্তাদি শিখিয়া বসে; ধনী হইতে চায়, টাকা জমাইয়া কৃপাপাত্র হইয়া ওঠে; দেশের হিত চায়, কমিটিতে রেজোল্যুশন পাস করিয়াই নিজেকে কৃতার্থ মনে করে।” আজ তিনি হয়তো আর এই কথাগুলি বলারও উৎসাহ সংগ্রহ করতে পারতেন না, লক্ষ্য এখন চাপা পড়ে নেই, অন্তর্হিত হয়েছে, সর্বত্র সর্বদা কেবল উপলক্ষই রাজত্ব করছে।

কিন্তু লক্ষ্য কী? ওই প্রবন্ধে কোন লক্ষ্যের কথা বলছিলেন রবীন্দ্রনাথ? তার উত্তর শিরোনামেই বলা আছে। বস্তুত, কেবল এই প্রবন্ধের উপলক্ষে নয়, সামগ্রিক ভাবেই একটি সার্থক জীবনের লক্ষ্য হিসাবে তিনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সৌন্দর্যবোধকে এবং সেই বোধ জাগ্রত করবার সাধনাকে অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছেন। আপাতবিচারে সেটা তাঁর কবিমনের লীলা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার গভীরে ছিল এক অতি গভীর সমাজচেতনা। রবীন্দ্রনাথের কাছে সৌন্দর্য কখনও মঙ্গল থেকে, কল্যাণ থেকে বিযুক্ত নয়। ওই প্রবন্ধেই লিখেছিলেন তিনি, “বস্তুত মঙ্গল মানুষের নিকটবর্তী অন্তরতম সৌন্দর্য; এইজন্যই তাহাকে আমরা অনেক সময় সহজে সুন্দর বলিয়া বুঝিতে পারি না, কিন্তু যখন বুঝি তখন আমাদের প্রাণ বর্ষার নদীর মতো ভরিয়া ওঠে। তখন আমরা তাহার চেয়ে রমণীয় আর কিছুই দেখি না।” মঙ্গল তথা কল্যাণের সঙ্গে সৌন্দর্যের এই আত্মিক ও অন্তর্লীন সম্পর্কটির কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বারংবার কুবেরের সঙ্গে লক্ষ্মীর তুলনা করেছেন: কুবের কেবল ‘টাকা জমাইয়া কৃপাপাত্র’ হতে পারেন, কল্যাণী লক্ষ্মীর শ্রী ও সৌন্দর্য তাঁর অধরা। পরবর্তী জীবনে, বিশেষত উনিশশো কুড়ির দশকে গ্রামবঙ্গে সমবায়ের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি এই কল্যাণকে সরাসরি সম্পদের বণ্টনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখেছেন, স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে বৃহদাংশিকের উৎপন্ন সামগ্রী ন্যূনাংশিক আত্মসাৎ করে ধনী হতে পারে, কিন্তু সেই ধন সৌন্দর্যের বিপরীত। সামাজিক সম্পদের বণ্টনে ও ভোগে সুষমতা থাকলে তবেই প্রকৃত সৌন্দর্যবোধ পরিতৃপ্ত হতে পারে, এই সত্য তাঁর বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই তিনি জোর দেন স্বাভাবিক সংযমের উপরে, মনে করিয়ে দেন যে, “সৌন্দর্যকে পুরামাত্রায় ভোগ করিতে গেলে এই সংযমের প্রয়োজন...”, এবং তার পরেই এক অলোকসামান্য উপমা সৃষ্টি করে বলেন: “সৌন্দর্যসৃষ্টি করাও অসংযত কল্পনাবৃত্তির কর্ম নহে। সমস্ত ঘরে আগুন লাগাইয়া দিয়া কেহ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায় না।”

আজ তাঁর বঙ্গভূমি যেখানে এসে পৌঁছেছে সেখানে প্রতিনিয়ত জীবনের সর্বস্তরে অসংযম, অকল্যাণ এবং অসুন্দরের উৎকট রাজত্ব চলছে। বস্তুত, তাঁর আপন শান্তিনিকেতনে ও বিশ্বভারতীতে সেই রাজত্বের যে রূপ দেখা যাচ্ছে, তা আক্ষরিক অর্থেই যে কোনও সুচেতন নাগরিকের বিবমিষা উৎপাদন করবে। এই রাজ্যের, বিশেষত তার রাজধানী শহরের, বহিরঙ্গে হয়তো কোথাও কোথাও কিছুটা রঙের প্রলেপ পড়েছে, ইতস্তত আলোর রোশনাইও দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেই আলগা চটককে রবীন্দ্রনাথ অন্তত সৌন্দর্য বলে স্বীকার করবেন না। পঁচিশে বৈশাখের গৎ-বাঁধা গান, নাচ, আবৃত্তি, কাব্যপাঠ, বক্তৃতা সাঙ্গ করে বঙ্গবাসী যখন নিজের কাছে ফিরবেন, তখন অন্তত একটি বার সামাজিক কল্যাণের বোধের সঙ্গে আপন সৌন্দর্যবোধকে মিলিয়ে দেখতে পারবেন কি? যদি পারেন, তবে বুঝতে হবে সব এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তখন হয়তো বা, মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখেই, রবীন্দ্রনাথ বলবেন: বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy