—প্রতীকী ছবি।
লোকসভা নির্বাচনের প্রথম তিনটি পর্যায় ইতিমধ্যেই সমাপ্ত। কোন কোন প্রশ্নের ভিত্তিতে ভোট চাইছে রাজনৈতিক দলগুলি? সর্বভারতীয় মঞ্চে প্রধানতম কুশীলব নরেন্দ্র মোদীকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বুঝি দশক দুয়েক পিছিয়ে গিয়েছেন। এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িকতাই তাঁর রাজনীতির মুদ্রা। নির্বাচন কমিশনের ভাবভঙ্গিতে যে-হেতু মনে হয় যে, প্রধানমন্ত্রী যা-ই করুন না কেন কমিশনের তাতে আপত্তি নেই, ফলে তিনিও বেলাগাম হয়েছেন। পাশাপাশি রয়েছে রামমন্দিরের আবেগ উস্কে তোলার চেষ্টা। নির্বাচনী প্রচারের অন্য দিকে রয়েছে দুর্নীতির প্রশ্ন। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গবাসীরা টের পাচ্ছেন যে, সেই তর্কটিও শেষ অবধি ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়িতেই শেষ হয়। এমনকি, প্রধানমন্ত্রী এই প্রশ্নটিকেও রাঙিয়ে দিতে পারেন সাম্প্রদায়িক রঙে। এ ছাড়া রয়েছে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। যাকে বিজেপি ‘রেউড়ি রাজনীতি’ বলে থাকে, ভোটের মুখে সেই পথেই ‘লাডলি বহেনা’ প্রকল্পের থেকে সুবিধা নিংড়ে নিতে তারা পিছপা হয় না বিন্দুমাত্র। এখানে একটি কথা স্পষ্ট বলা প্রয়োজন— সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি সর্বাংশে বর্জনীয়, কিন্তু দুর্নীতি বা প্রত্যক্ষ সুবিধা হস্তান্তরের প্রকল্পের কথা নির্বাচনী পরিসরে এলে তাতে এমনিতে আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু, সেই প্রশ্নগুলি যদি জননীতি আলোচনা করার বদলে শুধুমাত্র কুকথার বন্যা বইয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়, অথবা ‘ক্লায়েন্টেলিজ়ম’-কে বৈধতা প্রদান করতে, তা হলে সেই প্রশ্নগুলি শেষ অবধি উন্নয়নের কোনও সোপানেই পৌঁছয় না।
সিপিআই নেতা ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিনি নিজের লোকসভা নির্বাচনী ক্ষেত্রে প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, রাস্তা তৈরি হবে বা পানীয় জলের ব্যবস্থা হবে, এমন প্রত্যাশায় যেন কেউ তাঁকে ভোট না দেন। সেই কাজগুলি সাংসদের নয়। সাংসদের প্রধানতম দায়িত্ব, দেশের আইন প্রণয়নে, নীতিনির্ধারণ সংক্রান্ত বিতর্কে অংশগ্রহণ করা; তিনি যে জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই তর্কে তার স্বার্থরক্ষা করা। সাংসদ পদের সেই গুরুত্বের কথা এখন কারও স্মরণে না থাকলে দোষ দেওয়া মুশকিল— গত দশ বছরে সংসদে যত গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ হয়েছে, তার কত শতাংশের ক্ষেত্রে আইনসভায় যথেষ্ট আলোচনার সুযোগ ছিল? কিন্তু, তার পরও স্মরণে রাখা জরুরি যে, লোকসভা নির্বাচন অন্য নির্বাচনগুলির চেয়ে পৃথক— এই নির্বাচনের প্রার্থীরা দেশের আইনপ্রণেতা হওয়ার অনুমোদন চাইতে এসেছেন। তাঁদের প্রচারে যদি সে দায়িত্বের তিলমাত্র ছায়াও দৃষ্টিগোচর না হয়, তবে সংশয় হতে বাধ্য যে, তাঁরা কি আদৌ নিজেদের দায়িত্বের কথা জানেন?
কর্মসংস্থান থেকে আর্থিক অসাম্য, বেহাল শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প, শ্রমিক অধিকার থেকে সংখ্যালঘু বা দলিতদের অধিকারের প্রসঙ্গ— নির্বাচনী প্রচারে আসতে পারত অনেক কথাই। এই যেমন, পশ্চিমবঙ্গে চা-বাগান এবং চটকল, দু’টি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধানসূত্র খোঁজা দরকার হয়ে পড়েছে দেশের সার্বিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে। সেই প্রশ্নগুলি কোথায়? আবার, এনএফএইচএস-৫’এর পরিসংখ্যান বলছে, নাবালিকা বিবাহের মতো একটি ভয়ঙ্কর বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ দেশে সর্বাগ্রগণ্য। এই রাজ্যে বিরোধী দলগুলির প্রচারে কি এক বারও সেই প্রসঙ্গটি এসেছে? এমনকি যে বামপন্থীরা কোভিড-এর সময় কমিউনিটি কিচেন চালিয়েছেন, তাঁরাও কি নির্বাচনী প্রচারে এমন সরকারি প্রকল্প তৈরির দাবি করছেন? উত্তরাধিকার কর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলি বললেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে, তিনি কোন পক্ষে আছেন— ভারতের তুমুল আর্থিক অসাম্যের মধ্যে দাঁড়িয়েও কি বিরোধী পক্ষ সেই অবস্থানকে প্রশ্ন করার সাহস দেখাতে পারল? রাজনীতি যে কেবল কাদা ছোড়াছুড়ি নয়, এই কথাটি ভারতীয় রাজনীতি সম্ভবত সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে তারই প্রমাণ স্পষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy