ফাইল চিত্র।
এত দিন যাহা ছিল অনুমান এবং সংশয়, রবিবারের ব্রিগেড তাহা প্রশ্নাতীত রকম স্পষ্ট করিয়া দিল— পশ্চিমবঙ্গের বাম কুলপতিরা আব্বাস সিদ্দিকি নামক ধর্মগুরুর ভরসায় নির্বাচনী বৈতরণি পার হইতে ব্যাকুল হইয়াছেন। ব্রিগেডের মঞ্চে তিনিই ছিলেন মধ্যমণি। আব্বাস কিন্তু তাঁহার রাজনীতি গোপন করেন নাই। ব্রিগেডের পূর্বে, এবং রবিবারের মঞ্চ হইতে, তিনি যাহা জানাইয়াছেন, তাহাতে কয়েকটি কথা স্পষ্ট। এক, তাঁহার নিকট এই জোটের একমাত্র গুরুত্ব নির্বাচনী ময়দানে নিজের ওজন প্রমাণ; দুই, এই জোটের প্রতি তাঁহার তত দায়বদ্ধতা নাই, নির্বাচনের পর জোট থাকিবে কি না, সেই ভরসাও নাই; তিন, বামপন্থীদের জোটসঙ্গী কংগ্রেসের প্রতি সিদ্দিকির বিরোধ— সম্ভবত কিছু অঞ্চলে মুসলমান ভোটের উপর কাহার কত দখল সেই হিসাব কষিয়া। অর্থাৎ, ব্রিগেডের বিপুল ভিড়ের সম্মুখে যে মোর্চার ঘোষণা শোনা গেল— তাহার শরীরে মহৎ আদর্শ কিংবা বৃহৎ লক্ষ্যের বদলে ক্ষুদ্র ও সঙ্কীর্ণ স্বার্থের জন্মদাগ অনপনেয়। প্রশ্ন হইল, ভোটের তবে এমনই তাগিদ যে, বামপন্থী দলগুলি ধর্মনিরপেক্ষতার যাবতীয় বুলি ছাড়িয়া প্রকট সাম্প্রদায়িক সিদ্দিকির সহিত জোট বাঁধিল? তাঁহার পশ্চাৎমুখী মানসিকতা ও সুযোগসন্ধানী অবস্থানকে মান্যতা দিল? আব্বাস সিদ্দিকি ফ্রান্সে মুসলমান মৌলবাদী হামলাকে সমর্থন জানাইয়াছেন, সাংসদ নুসরত জাহানকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করিয়াছেন। তিনি মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি নহেন, সেই সমাজের পশ্চাৎমুখী কট্টরবাদের প্রতীক। তাঁহাকে জোটসঙ্গী করিয়া ধর্মনিরপেক্ষতার কোন বার্তা দিতেছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট?
তাঁহারা এই জোটের পক্ষে দুইটি যুক্তি খাড়া করিবেন। এক, সিদ্দিকির সহিত জোট না হইলে মুসলমান ভোটের একাংশ হাতছাড়া হইত। দুই, জোটসঙ্গী হইবার কারণে সিদ্দিকিকে তাঁহার বাড়াবাড়িগুলি নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক’ পথে কথা বলিতে হইবে। কিন্তু কিসের ভরসায় বাম নেতাদের এই হিসাব? রাজ্যের মুসলমান ভোটের উপর সিদ্দিকির নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা এখনও হয় নাই। ফলে, শুধু সেই অঙ্কে তাঁহার দলের সহিত জোট করা, বা জোটের অন্য শরিকদের তুলনায় তাঁহাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক কি না, সেই প্রশ্নেরও মীমাংসা হয় নাই। কিন্তু, তাহার তুলনায় অধিক তাৎপর্যপূর্ণ কথাটি হইল, জোটের স্বার্থে সিদ্দিকি যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণও করেন, তাহাতে তাঁহার অতীত মুছিয়া যায় না, ভবিষ্যৎও নির্ধারিত হয় না। যে পশ্চাৎমুখী সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান তাঁহার অভিজ্ঞান, সেই পরিচিতি যথাপূর্বং থাকিবারই সমূহ সম্ভাবনা। কয়েকটি আসনের লোভে বাম নেতারা এই বিপজ্জনক সঙ্গীকে বাছিয়া লইলেন, এই দুর্ভাগ্য ইতিহাসে লেখা থাকিবে।
সর্বাধিক দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অনুপ্রবেশে রাজ্যের অপূরণীয় ক্ষতি ইতিমধ্যেই হইয়াছে। তাহার বিপ্রতীপে এই বার মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মূলধারার জোটে ঠাঁই করিয়া দিলেন বামপন্থীরা। অর্থাৎ, উল্টা দিক দিয়া হিন্দুত্ববাদীদের অবস্থানটিকেই তাঁহারা আরও শক্তপোক্ত করিলেন। বুঝাইয়া দিলেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি অতঃপর আবর্তিত হইবে ধর্মীয় পরিচিতির অক্ষে। এই জোটটি না হইলেও হয়তো আব্বাস সিদ্দিকি রাজ্য রাজনীতির মঞ্চে অবতীর্ণ হইতেন, যেমন হইতেছেন আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। কিন্তু, এই জোটটি না হইলে সেই রাজনীতিকে এতখানি মান্যতা দেওয়া হইত না। এই কথাটি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তারা বোঝেন না, বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু, তাঁহারা সম্ভবত ক্ষুদ্র রাজনীতির সমীকরণেই আস্থা রাখিতেছেন। কোথায় কয় আনা ভোট কাটিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসুবিধা, সেই অঙ্কের বেড়া টপকাইয়া পশ্চিমবঙ্গের বিপদটি তাঁহারা গ্রাহ্যও করিতেছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy