Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Technology

মিথ্যান্বেষী

প্রযুক্তির কারবারিরা এই সত্যটি বিলক্ষণ অবগত আছেন যে, প্রযুক্তি যত ডালে ডালে উন্নত হইবে, মানুষও হয়তো ততই পাতায় পাতায় ঘুরিয়া তাহাকে ধোঁকা দিতে শিখিবে।

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:১৯
Share: Save:

ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে উচ্চকণ্ঠে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শুনাইবার পরে নিহতের প্রকৃত পরিচয় জানাইবার সময় যখন স্বর নামাইয়া লন, তখন কি তাঁহার মুখের পেশি ও স্নায়ুতে কোনও বিকৃতি ঘটিয়াছিল? মহাভারতকার তাহা বলেন নাই। ইজ়রায়েলের উদ্যমী গবেষকরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। থাকিলে, তাঁহারা সেই সুকঠিন মুহূর্তটিতে নির্ঘাত জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের ওষ্ঠের পাশে এবং ভ্রুযুগলের উপরে কয়েকটি ‘প্যাচ’ লাগাইয়া দিতেন এবং তাহাদের সংলগ্ন ‘ইলেকট্রোড’ মারফত তাঁহার মনের খবর বিশ্লেষণ করিয়া দ্রোণাচার্যকে জানাইয়া দিতে পারিতেন যে, ধর্মরাজ প্রকৃত সত্য গোপন করিতেছেন। বেদব্যাসকে মহাভারতের কাহিনি হয়তো অন্য ভাবে লিখিতে হইত। এই অবধি শুনিয়া তেল আভিভ ইউনিভার্সিটির ওই বিজ্ঞানীরা সম্ভবত জানাইয়া দিবেন, তাঁহাদের যন্ত্রবিদ্যা এখনও নির্ভুল নহে— তাঁহাদের গবেষণা অনুযায়ী প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে মুখের পেশি ও স্নায়ুর সঞ্চালন হইতে সত্যাসত্যবিনিশ্চয় সম্ভবপর হইয়াছে। এই কথাটি না জানাইলে তাঁহারা বিজ্ঞানের ধর্ম হইতে ভ্রষ্ট হইবেন। বিজ্ঞান সত্যের সন্ধানী, অর্ধসত্যের বেসাতি তাহার কাজ নহে, সেই বৃত্তি যাঁহাদের হস্তগত তাঁহারা বিজ্ঞানীর ভেক ধরিতে পারেন, এইমাত্র। বলা বাহুল্য, প্রযুক্তিটির উন্নতি সাধনের জন্য গবেষণা চলিতেছে। সহজবোধ্য কারণেই এই গবেষণায় উদ্যমের ঘাটতি হইবে না, অর্থেরও অভাব হইবে না, বিশেষত ইজ়রায়েলের মতো দেশে, গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক সত্য অনুসন্ধানের প্রযুক্তির পিছনে রাষ্ট্রীয় তথা বাণিজ্যিক বিনিয়োগ যেখানে বিপুল, তাহার কূটনৈতিক এবং ব্যবসায়িক লাভের মাত্রাও বিরাট— পেগাসাস স্মরণীয়।

তবে কিনা, প্রযুক্তির কারবারিরা এই সত্যটি বিলক্ষণ অবগত আছেন যে, প্রযুক্তি যত ডালে ডালে উন্নত হইবে, মানুষও হয়তো ততই পাতায় পাতায় ঘুরিয়া তাহাকে ধোঁকা দিতে শিখিবে। বস্তুত, তাঁহারা এই সাবধানবাণী স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ভাষায় শুনাইয়াও দিয়াছেন। পলিগ্রাফ বা তথাকথিত ‘লাই ডিটেক্টর’কে ফাঁকি দিবার কৌশল কালক্রমে বহু লোকেই শিখিয়া ফেলিয়াছেন এবং তাহার ফলে সেই প্রযুক্তি অনেক সময়েই তাঁহাদের মনের কথা পড়িতে ব্যর্থ হইয়া থাকে, তাহার ফলে এই যন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সংশয় ক্রমেই বাড়িয়াছে। আপন স্নায়ু এবং পেশির উপর সচেতন মানুষের নিয়ন্ত্রণ অসীম না হইতে পারে, কিন্তু অসাধ্য নহে, এবং সাধ্য ক্রমশ বাড়িতেই পারে। অতএব মিথ্যান্বেষী সাবধান— সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য জ্ঞান করিয়া যন্ত্র বেকুব বনিতে পারে।

মনের ভাব গোপন রাখিবার কৌশল মানুষ নূতন শিখিতেছে না। মিথ্যা বলিবার সময় মনের সত্যটি সর্বদা মুখের রেখায় ধরা পড়িলে পৃথিবীতে কত লক্ষ কাহিনি যে অন্য ভাবে রচিত হইত তাহার ইয়ত্তা নাই। লোকের কথায় লোকে বিশ্বাস করিবে অথবা করিবে না— তাহা বহুলাংশে নির্ভর করে বক্তার বিশ্বাসযোগ্যতার উপরে, যে বিশ্বাসযোগ্যতা তাঁহার দীর্ঘ দিনের আচরণের মধ্য দিয়াই অপরের মনে দানা বাঁধে অথবা বাঁধে না। এই কারণেই, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আঁচে পোড় খাইয়া নাগরিকরা অনেকেই রাজনীতিকদের বিবিধ সুবচনকে সচরাচর কথার কথা বলিয়াই গণ্য করেন, এমনকি ভোটের আগে নায়কের উচ্চারিত তালগাছ-প্রমাণ প্রতিশ্রুতিকে ভোট মিটিবার পরেই সহনায়ক হাটের মাঝে কথার কথা বলিয়া উড়াইয়া দিলেও বহু লোকে কিছুমাত্র বিস্মিত বা বিচলিত হন না, তাঁহারা প্রতিশ্রুতির বারিতে সিঞ্চিত হইবার সময়েই সত্যটি জানিতেন। মুখ দেখিয়া কি এমন সব ভিতরের খবর কখনও জানা সম্ভবপর হইবে? বিজ্ঞানীরা অবশ্যই জানেন, তাঁহাদের কাজ অতি কঠিন, যথার্থ কুশলী বক্তার মনোরথ তাঁহার মুখের রেখায় একটি দাগও রাখে না, অন্দরের স্নায়ু ও পেশিতেও রাখিবে কি? যে অভ্যাস ও অনুশীলনের মধ্য দিয়া কুশলী বক্তারা এই বিভ্রম সৃষ্টি করিতে পারেন, তাহাই হয়তো প্রকৃত মহাবিদ্যা। সংশয় হয়, ক্রমাগত সত্য গোপন এবং মিথ্যা প্রকাশ করিতে করিতে বক্তার চেতনাতেও কি মিথ্যাই সত্য বলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়? বক্তা নিজেও বিশ্বাস করেন তিনি যাহা বলিতেছেন তাহাই সত্য? মনে পড়িতে পারে টোনি ব্লেয়ারের সেই উক্তি; ইরাক আক্রমণের যুক্তি হিসাবে তিনি জানিয়া শুনিয়া অসত্যের আশ্রয় লইয়াছেন, এই অভিযোগের জবাবে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছিলেন: আমি কেবল সেইটুকুই জানি, যাহা আমি বিশ্বাস করি। হায় যুধিষ্ঠির, টোনি ব্লেয়ারদের পাঠশালায় পড়িবার সুযোগ তাঁহার হয় নাই।

যৎকিঞ্চিৎ

বাবাকে লেখা মেগান মার্কল-এর চিঠি ছেপে দিয়েছিল এক আমেরিকান কাগজ। সেই নিয়ে মামলায় আদালত রায় দিয়েছে মেগানের পক্ষেই: ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ হয়েছে, অন্যায় হয়েছে। ও দিকে রাজপরিবার শিহরিত: নাহয় প্রাসাদ ছেড়েছে, তবু তো রানির ঘরের বৌ, সে কি না শেষে এজলাসে! একাকী লড়াইয়ে মেগান কিন্তু বুঝিয়ে দিল, বিখ্যাত মানুষও মানুষ। তার জীবন নিয়ে লোকের যতই আগ্রহ থাক, তার জীবন জনগণের সম্পত্তি নয়। ‘পাবলিক পার্সন’-ও শেষ অবধি ‘পার্সন’।

অন্য বিষয়গুলি:

Technology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy