সত্য বড় বিষম বস্তু। রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপের ফলে তাতে কোপ পড়লে গণতন্ত্রের বিপদ, আবার শাসকবর্গের কায়েমি স্বার্থে তার বাগাড়ম্বরও সমস্যাকর। বস্তুত, সত্যকে সহজ ভাবে প্রকাশিত হতে না দিলে তা কি আর সত্য থাকে? দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবির কথাই ধরা যাক। একটিমাত্র চলচ্চিত্রকে ঘিরে যে ভাবে সরকারি সমর্থন, অর্থ ও প্রচারের বান ডেকেছে, তাতে ভ্রুকুঞ্চিত হতে বাধ্য। প্রশ্ন উঠবেই, সব ছাপিয়ে এই ছবিটিকে এতখানি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী? প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সকলেই এই ছবির প্রশংসায় আত্মনিয়োগ করেছেন কেন? ছবিটিকে নিয়ে এখন যা হচ্ছে, তা আর শুধু দৃষ্টিকটু বা বিপজ্জনক নয়, ঘোরতর অনৈতিক। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এ ছবি শাসক দলের স্বার্থসিদ্ধি করে, তাই তাকে জনদরবারে যথাসম্ভব পৌঁছে দিতে, এবং সম্ভব হলে তা নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করতে তারা একান্ত উদ্গ্রীব। তা আর এখন নিছক শিল্প নয়— প্রচার।
প্রচারের সমস্যাটি বোঝা দরকার। সেখানে পাথুরে প্রমাণের চেয়ে আবেগ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আবেদন শতগুণে অধিক। অতএব বিশেষজ্ঞরা যদি বলেনও যে, এই ছবিতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের যথাযথ ইতিহাস দেখানো হয়নি, তা হলেও এই ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বা সত্য-উত্তর জমানা তাকে ধ্রুব বলে মেনে নেবে না। এ যুগে বিশেষজ্ঞদের সত্যের বাইরেও সত্য থাকতে পারে, এযাবৎ কাল জেনে আসা সত্য পাল্টে যেতেও পারে— সত্যের নানা রূপই ‘পোস্ট-ট্রুথ’ রাজনীতির মূল কথা, কখনও মিথ্যাও সেখানে সত্য। শত ‘সত্য’-এর পুষ্প এমন ভাবে ইতিউতি বিকশিত হওয়াও আজকাল সহনীয় এবং বহনীয়, এমনকি কেউ বলতে পারেন, সমাজ বা বাজারের পক্ষে চিন্তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশ স্বাস্থ্যকর। কিন্তু, খোলা বাজারের মধ্যে যদি রাজনৈতিক শক্তি কোনও এক ‘সত্য’-এর সমর্থনে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে— তা হলে আর স্বভাবতই বিষয়টি এক রকম থাকে না। স্পষ্টতই সেই সরকারি প্রণোদনা সমাজে একটা বিরাট গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে, এবং অন্য সকল মতকে চুপ করিয়ে দিতে চায়। এই রাজনীতি এখন ভারতের অজানা বা অপরিচিত নয়। হিন্দুত্ববাদের প্রসারের দায়িত্ব কী ভাবে রাষ্ট্রের নিরাপদ হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা মোদী’জ় ইন্ডিয়া গ্রন্থে বিশদে আলোচনা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টাভ জাফরেলো, কিন্তু দ্য কাশ্মীর ফাইলস নিয়ে ভারতে যা ঘটল, তাকে এখনও পর্যন্ত অভূতপূর্ব বলা চলে।
আশঙ্কার কথা, এই ঢক্কানিনাদের প্রভাব আর কেবল জনমনে থাকছে না, বাস্তবের জমিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে। গত তিন বছরে ভারত সরকারের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক ভাবে কাশ্মীর বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত, অতএব ভারতের কাছে বিপজ্জনক। সরকার যদি আপন রাজনৈতিক স্বার্থে সেই পরিস্থিতিকে এখন আরও উস্কে দেয়, তা হলে সংঘাত কোন স্তরে পৌঁছে যেতে পারে তা হয়তো কল্পনাও করা যাচ্ছে না। এ যেন বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে বীরত্বের আস্ফালন! সরকার যখন ক্রমাগত ভুল করে চলে, দায়িত্ব তখন নাগরিক সমাজের। সামাজিক স্তরে এই ছবি ঘিরে ন্যক্কারজনক উৎসাহবন্যায় লাগাম পরানোর ডাক দেওয়া কিংবা অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস এখন আর অবশিষ্ট নেই। সুতরাং, গভীর আঁধারে ডুবে যাওয়া ছাড়া এ দেশের আর কোনও ভবিতব্য নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy