ফাইল চিত্র।
ঋণ করিয়া ঘি খাইবার পরামর্শ দিয়া অমর হইয়াছেন চার্বাক দার্শনিকরা। এখন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সম্মুখে নূতন বিতর্ক— লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রভৃতি প্রকল্পগুলি কি খাদ্যবিলাসীর ঘি, না কি নিরন্নের অন্ন? বিশ্বব্যাঙ্ক ঋণ দিতে প্রস্তুত। প্রশ্ন হইল, যে ঋণের বোঝা বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজ্যবাসীকে বহিতে হইবে, তাহার অর্থে কি এই প্রকল্পগুলি চালানো উচিত হইবে? দরিদ্রের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করিবার নীতির ন্যায্যতা তবু বোঝা যায়। কিন্তু, বিশ্বব্যাঙ্ক যাহার জন্য ঋণ দিতে চাহে, অর্থাৎ ‘নারী ক্ষমতায়ন’? কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, কেন তাহার জন্য সরকারকে টাকা ধার করিতে হইবে? বিশেষত ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ কেবল দরিদ্র পরিবারগুলির জন্যই নির্দিষ্ট নহে। আর্থিক ভাবে সচ্ছল পরিবারের মহিলাদের সহায়তায় কেন বিশ্বব্যাঙ্কের দুয়ারে দাঁড়াইবে সরকার? কারণ, আর্থিক অসমতার বাহিরেও লিঙ্গ অসমতার পরিসর রহিয়াছে। সেই পুরুষ-নারী বৈষম্য কমাইবার দায় রাষ্ট্রের। আর্থিক সহায়তা দান তাহার অন্যতম উপায়। মেয়েরা নিজেদের ইচ্ছায় রোজগার, প্রেম, বিবাহ এবং সন্তানধারণ যেমন করিবেন, তেমনই আপন ইচ্ছায় আর্থিক লেনদেনও করিবেন, ইহাই কাম্য। কিন্তু বহু সচ্ছল পরিবারেও মেয়েদের সেই সুযোগ নাই। রাষ্ট্র মেয়েদের হাতে অর্থ দিয়া, তাহাদের ইচ্ছানুসারে খরচের অধিকারকে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি দান করিল।
ইহা সত্য যে, নারীর সক্ষমতা বাহির হইতে দিবার বস্তু নহে— অন্তরের শক্তিকে প্রকাশ করিবার পথে বাধা অপসারণ করিলেই যথেষ্ট। আক্ষেপ, রাজনীতি সাধারণত জনসমর্থন পাইবার তাগিদে নারীর স্বাতন্ত্র্য অপেক্ষা তাহার উপর পরিবারের আধিপত্যকে অধিক গুরুত্ব দেয়। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ ব্যতিক্রম বলিয়াই হয়তো অর্থবরাদ্দ লইয়া শোরগোল বাধিয়াছে। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রভৃতিরও ঘোষিত উদ্দেশ্য নারী ক্ষমতায়ন, কিন্তু ওই অনুদানগুলিকে পরিবার কার্যত কন্যার বিবাহের খরচে সরকারি ‘ভর্তুকি’ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে। অথবা তাহা যেন ‘ক্ষতিপূরণ’— কন্যাসন্তান জন্মাইবার ‘ক্ষত’ ঢাকিতে কিঞ্চিৎ টাকার প্রলেপ। কিন্তু ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পটি মেয়েদের আপন ইচ্ছায় ব্যয়ের উদ্দেশেই পরিকল্পিত। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইহাকে মেয়েদের ‘হাতখরচ’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ক্ষমতায়নের দৃষ্টিতে তাহার বিশেষ তাৎপর্য রহিয়াছে বলিয়াই তাহার আর্থিক দায় রাজ্যবাসীকে স্বীকার করিতে হইবে।
মহিলাদের হাতে খরচ করিবার অর্থ দিলে তাহা সাধারণত পরিবারের কল্যাণেই নিয়োজিত হইয়া থাকে, ইহা অর্থশাস্ত্রের যুক্তি। অতিমারিতে অগণিত মেয়ে কাজ হারাইয়াছে, শ্রমশক্তিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ইতিহাসে সর্বনিম্ন। দেশে দারিদ্র বাড়িয়াছে, ভোগব্যয় কমিয়াছে। অপুষ্টি, অশিক্ষা নিরসনের অন্যতম উপায় অনুদান, মেয়েদের সে অর্থ দিলে তাহা সদ্ব্যবহারের সম্ভাবনা অধিক। অবশ্যই ঋণের অর্থের বণ্টনে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার প্রয়োজন। প্রকল্পের সুবিধা হইতে বিরোধীদের বাদ রাখিবার রাজনৈতিক ঝোঁকও অতিক্রম করিতে হইবে। বিশ্বব্যাঙ্ক স্বাধীন সমীক্ষক সংস্থা নিয়োগ করিবে। কিন্তু নিয়ত নজর রাখিবে নাগরিক, সেই অনুসন্ধানী দৃষ্টিকে সম্মান করিতে হইবে সরকারকে। নাগরিকের ক্ষমতাকে লঘু করিয়া নারী ক্ষমতায়ন হইবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy