শেয়ার বাজারে অভিষেকেই সাড়া ফেলিয়াছে এক ভারতীয় প্রসাধনী-নির্মাতা স্টার্ট-আপ। এই বিস্ফোরক বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি কয়েক দশক পূর্বের কথা ভাবিলে অবাক লাগিতে পারে। সেই সময় এই দেশের এক প্রধান শিল্পগোষ্ঠী মেক-আপ উৎপাদনের ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছিল। ভারতে সেই প্রথম। সেই সময় সংস্থাটির বাজার ধরিতে কালঘাম ছুটিয়া গিয়াছিল। আজকের ভারতে প্রসাধনীর বাজারের ভরসায় লগ্নিকারীরা কিন্তু এমন ব্যবসার শেয়ার কিনিতে ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারেন। পরিবর্তন এমন ভাবেই অলক্ষ্যে ঘটিয়া যায়, কেননা পরিবর্তিত হইয়া যায় সমাজের চরিত্র। প্রসাধনীর বাজারে ক্রেতা মূলত মহিলারাই— আজও, অর্ধ শতক পূর্বেও। সেই আমলে মহিলারা সাজিতেন না, তেমন দাবি নিতান্ত অনৈতিহাসিক হইবে, কিন্তু সেই সাজের চরিত্র ছিল এক অর্থে স্বদেশি— টিপ, কাজল, খানিক স্নো-পাউডার। প্রসাধনীর যে পাশ্চাত্য রূপ, সেই ফাউন্ডেশন-ব্লাশ অন-কমপ্যাক্ট-কনসিলার-আই পেনসিল ইত্যাদির প্রতি ভারতীয় মহিলাদের একটি ঘোষিত সামাজিক অভক্তি ছিল। পরবর্তী কালে একাধিক বাজার সমীক্ষায় সেই অভক্তির কিছু ব্যাখ্যা ফুটিয়া উঠিয়াছে। অধিকাংশ মহিলা— কর্মরতারাও— বলিয়াছিলেন যে, মেক-আপের সহিত চারিত্রিক স্খলনের সামাজিক সমীকরণটি প্রতিষ্ঠিত ছিল।
১৯৯০-এর দশকে বিশ্বায়ন আসিয়া সেই সমীকরণটিকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে, এমন বলিলে কালক্রমটি বিলক্ষণ বোঝা যাইবে, কিন্তু ইহাতেও সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা মিলিবে না। সত্য যে, বিশ্বায়নের আদি পর্বে স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও পরবর্তী কালে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে রূপ ও তাহার চর্চা বিষয়ে ভারতীয়দের ধারণা পাল্টাইয়াছে। বিশেষত, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্বী দিবার বৈশ্বিক প্রবণতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লইয়াছে। কিন্তু, পঞ্চাশ-ষাট, এমনকি আশির দশকে সোশ্যাল মিডিয়া না থাকিলেও সিনেমা ছিল— তাহার প্রভাবও সমাজে ছিল যথেষ্ট। চলচ্চিত্রের নায়িকার অনুসারী পোশাক বানাইবার চলটি নূতন নহে। কিন্তু, মেক-আপের ন্যায় শরীরের সহিত অতি ঘনিষ্ঠ একটি বিষয়, যাহাকে সমাজ মূলগত ভাবে নারীকেন্দ্রিক পণ্য হিসাবেই দেখিয়াছে, তাহা লইয়া অস্বস্তি, এবং সেই অস্বস্তি ঘুচিবার কারণটি শুধুমাত্র বহির্বিশ্বের সহিত ঘনিষ্ঠতর সংযোগের যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। মহিলারা মেক-আপ প্রসাধনী লইয়া দ্বিধান্বিত ছিলেন— বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রকাশ যে, গোপনে মেক-আপ ব্যবহার করিলেও বাড়িতে ফিরিবার পূর্বে তাহা সযত্নে মুছিয়া ফেলিতেন অনেকেই— কারণ, পুরুষতন্ত্র এই বস্তুটিকে সন্দেহের চোখে দেখিত। তাহার ব্যবহারকে দেখিত পুরুষকে প্রলুব্ধ করিবার কৌশল হিসাবে। ইহাই পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টি— নারীকে সর্বদাই পুরুষের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা। কেহ যে শুধু আপনাকে সুন্দর দেখিতে চাহেন বলিয়াই সাজিতে পারেন, এই কথাটি পুরুষতন্ত্র মানে না। মানিলেও, তাহাকে যথেষ্ট বৈধ জ্ঞান করে না। গত কয়েক দশকে সমাজের এই অর্গলটিই ভাঙিয়াছে।
পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টি পাল্টায় নাই। পাল্টাইয়াছে মহিলাদের একাংশের আপেক্ষিক অবস্থান। মহিলাদের উপার্জনশীল হইয়া উঠা, সংগঠিত ক্ষেত্রে তাঁহাদের কর্মসংস্থানের সহিত মেক-আপ বিষয়ে সামাজিক ব্রীড়ার মাত্রা হ্রাস পাইবার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব। যত দিন একটি ফেস পাউডার কিনিবার জন্য মহিলাকে পুরুষের নিকট হাত পাতিতে হইয়াছে, তত দিনই পুরুষের মতামতই প্রাধান্য পাইয়াছে। অথবা, সেই মতামতের আশঙ্কাতে ফেস পাউডারটি কিনিবার কথাই বহু মহিলা ভাবেন নাই— পুরুষতন্ত্রের যুক্তিটিকেই আপন যুক্তির মান্যতা দিয়াছেন। উপার্জনশীল নারীর সেই সমস্যা নাই। ইহা দাবি করিবার প্রশ্ন নাই যে, মহিলারা উপার্জনশীল হওয়ামাত্রই স্বাধীন হইয়াছেন, পুরুষতন্ত্রের নিগড় ভাঙিয়া গিয়াছে। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে পুরুষতন্ত্রের এযাবৎ কালের কঠিনকঠোর দুর্গটিতে ছিদ্র বিলক্ষণ তৈরি হইয়াছে। এবং সেই ছিদ্রপথ গলিয়াই প্রসাধনী ঢুকিয়া পড়িয়াছে ভারতীয় মহিলাদের জীবনে। সমাজও ক্রমে এই অন্তর্ঘাতকে মানিতে শিখিয়াছে। প্রসাধনী ব্যবহার করাকে নারী স্বাধীনতার একটি সূচক হিসাবে দেখিলে কেহ আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু, প্রশ্নটি ব্যবহার করা না-করার নহে, প্রশ্নটি অধিকারের। নিজের মর্জিতে বাঁচিবার অধিকারের। ভারত যে সেই পথে অন্তত কয়েক কদম হাঁটিতে পারিয়াছে, এই অন্ধকার সময়ে দাঁড়াইয়া এইটুকু আশ্বাসই বা কম কী।
যৎকিঞ্চিৎ
জলজ উদ্ভিদ, শেওলা, ম্যানগ্রোভ— বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পারে। শাখায়, শ্বাসমূলে, কাদামাটিতে তা জমিয়ে রাখে। ফলে বাস্তুতন্ত্র নির্মল হয়! বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একমত, নীল কার্বনের খনি সামুদ্রিক বনভূমিকে বাঁচালে পৃথিবীর আয়ু বাড়বে। বিষেই তো বিষক্ষয়। অর্থাৎ কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর শত্রু নয়, সে-ই এখন পৃথিবীর রক্ষক। অক্সিজেনকে সে আজ ডেকে বলতে পারে, ‘উচ্চে আছ ব’লে গর্বে আছ ভোর, তোমারে করেছি উচ্চ এই গর্ব মোর।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy