ভারতীয় সংসদের বাদল অধিবেশন কিছু ইতিহাস রচনা করিল। মার্শাল দিয়া দুর্গ বানানো হইল রাজ্যসভায় বিল পাশ করাইবার আগে। বিরোধী পক্ষ ভাঙচুর করিল, বিলের প্রতিলিপি ছিঁড়িয়া উড়াইল, সরকার পক্ষ গায়ের জোর দেখাইয়া প্রবল কর্তৃত্বের সহিত সকল বিরোধিতা অগ্রাহ্য করিয়া বিল পাশ করাইল। ইহা মাত্র এক দিনের ব্যতিক্রমী ঘটনা নহে। এই অধিবেশনে একাদিক্রমে প্রায় দুই সপ্তাহ সংসদ কার্যত অচল করিয়া রাখিয়াছিলেন বিরোধী নেতারা, তাঁহাদের বিক্ষোভ প্রায়শই ধ্বংসাত্মক রূপও লইতেছিল। নির্বাচিত সাংসদদের কর্মবিরূপতা বা ধ্বংস-প্রবণতা লইয়া নূতন কিছু বলিবার নাই, বিশাল দেশ জুড়িয়া অতি-ব্যয়সাধ্য নির্বাচন-যজ্ঞ সাধনের পর জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সাংসদরা প্রতিনিধি আসনে বসিয়া যে আচরণ করেন, তাহাতে দেশবাসী লজ্জায় মাথা লুকাইবার স্থান পান না। কিন্তু অতীত ইতিহাস যেন ছাপাইয়া যাইবার জোগাড়। স্বাধীন দেশ পঁচাত্তর বৎসরটিতে পা দিবার প্রাক্কালে তাহার সংসদীয় গণতন্ত্র যেন স্পর্ধার উত্তুঙ্গ শিখরটি স্পর্শ করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছে। বিরোধীদের বিরোধিতার ঘৃণ্য রূপটি ঐতিহাসিক হইয়া থাকিল। আর তাহার সঙ্গে শাসক দল বিজেপির গণতন্ত্র অবমাননার কোনও সীমা-পরিসীমা নাই। বিরোধীদের সহিত আলোচনা না করিয়া, বিরোধী মতামত শুনিবার বা জানিবার কিয়ন্মাত্র তোয়াক্কা না করিয়া কেন্দ্রীয় শাসকবর্গ একের পর এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করিয়া নূতন নূতন আইন তৈরি করিয়া গেলেন। লিমিটেড লায়াবিলিটি পার্টনারশিপ সংশোধনী, বিমা সংশোধনীর মতো গুরুতর ক্ষেত্রে কোনও আলোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটে বিল পাশ হইয়া গেল। গণতন্ত্র তো কেবল ভোটগ্রহণ এবং সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সময়যাপন নহে। গণতন্ত্রকে অর্থময় করিয়া তুলিতে হইলে সংসদে কিছু নিয়মবিধি মানিয়া চলা একান্ত জরুরি, আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক ছাড়া এত বড় দেশের জন্য আইন পাশ কেবল অবাঞ্ছিত নহে— অনৈতিক। এই কারণেই, সংসদ অধিবেশনে কতগুলি আইন তৈরি হইল, তাহা তত গুরুত্বপূর্ণ নহে। কিন্তু সংসদে এই কয়েক সপ্তাহ যে চরম অগণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করিল, তাহা গভীর উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ।
বস্তুত, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নায়ডুর অশ্রুপাত ও বিলাপ, লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার আহত মন্তব্য— কিছুই ভুলাইয়া দিতে পারে না স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিপুল দায়িত্বের কথা। বিরোধীদের অসংখ্য প্রশ্নের মধ্যে তিনি যেন হিমাচলসদৃশ স্থির, নির্বাক, নিস্তরঙ্গ। যেন কোনও উত্তর দিবার দায় তাঁহার নহে, তাঁহার দলের বা সরকারের তো নহেই। গত বৎসরেও ঠিক একই কাজ করিতেন তিনি। বিরোধীদের প্রস্তাবিত বিল-বিষয়ক প্রশ্ন করিবার জন্য যে সময় নির্ধারিত, তাহা সোজা বাতিল করিয়া দিতেন। ২০১৯ সালেও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলিলে নরেন্দ্র মোদী তাহার সম্পূর্ণ পাশ কাটাইয়া অন্য কথা বলিয়া দিনের কাজ গুটাইয়া ফেলিতেন। অর্থাৎ, তাঁহার নীরবতা ও নির্বিকারতা কোনও ব্যতিক্রম নহে, ইহাই তাঁহার স্বৈরতান্ত্রিক কর্মপ্রক্রিয়া। বিরোধী নেতা তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের টুইটে অনুরোধ: প্রধানমন্ত্রী যেন তাঁহাদের কথা শুনিতে আসেন। রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেস সাংসদ মল্লিকার্জুন খড়্গের প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রীর কি স্নায়ুবিপর্যয় হইয়াছে বলিয়া তিনি কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন না? এত সব ক্ষোভ-বিক্ষোভ, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পরও প্রধানমন্ত্রী নির্বিকার। অনৈতিক, অসাংবিধানিক ভাবে, বিরোধী প্রশ্ন, সংশয় বা বিক্ষোভকে রাষ্ট্রবিরোধিতা বলিয়া দাগাইয়া দিয়া বর্তমান শাসক দল কর্তৃত্ববাদের ঘরানা প্রতিষ্ঠা করিতেছেন। সাধু সাবধান, যত সংখ্যক বিলই পাশ হউক না কেন, তাহা ভারতীয় গণতন্ত্র বিষয়ে ভাল কথা বলে না। ভারতীয় সংসদ গণতন্ত্র-ভ্রষ্ট হইয়াছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy