হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর ঘোষণা করিয়াছেন, অতঃপর মুসলমানদের প্রকাশ্যে নমাজ পাঠ তাঁহারা সহ্য করিবেন না। কেন, বর্তমান ঘোষণায় মুখ্যমন্ত্রী সেই ব্যাখ্যা দেন নাই। তাহার প্রয়োজনও নাই— সম্প্রতি সেই রাজ্যে প্রকাশ্যে নমাজকে কেন্দ্র করিয়া যে গৈরিক আগ্রাসন চলিয়াছে, তাহাতেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার কারণটি সম্পূর্ণ বিদিত। স্বীকার করা বিধেয় যে, মুসলমানদের প্রার্থনার অধিকারটিই সম্পূর্ণ খারিজ করিয়া দেন নাই হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী। জানাইয়াছেন, নিজস্ব গৃহে, অথবা মসজিদের পরিসরে নমাজ পাঠ করা যাইবে। কিন্তু, নমাজ পড়িবার জন্য ইতিপূর্বে যে জায়গাগুলি নির্দিষ্ট করা ছিল, সেইগুলির অনুমতি প্রত্যাহার করিয়া লওয়া হইতেছে। সিদ্ধান্তটির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় খট্টর বলিয়াছেন যে, অন্য ধর্মাবলম্বীরা যখন ব্যক্তিগত পরিসরেই ধর্মাচরণ সারিতে পারেন, মুসলমানদের ক্ষেত্রেই বা তাহা হইবে না কেন? তাঁহাদের জন্য কেন প্রকাশ্যে নমাজ পড়িবার ব্যবস্থা করিতে হইবে?
গণপরিসরের উপর তুলনামূলক দখলকে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি ন্যায্যতার মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করিবার এই পন্থাটি মনোহরলাল খট্টরের মস্তিষ্কপ্রসূত নহে। হিন্দুত্ববাদী বয়ানে ইহা বহু যুগ ধরিয়াই রহিয়াছে। কেন রাস্তা জুড়িয়া ইদের নমাজ হইবে, মহরমের দিন কেন পথে মিছিল বাহির হইবে ইত্যাদি হরেক আপত্তি ক্ষণে ক্ষণেই শ্রুত হইয়া থাকে। কিন্তু, সঙ্ঘ পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার পাশাপাশিই যে ভারতীয় সংবিধানের প্রতিও তাঁহাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে, খট্টররা এই কথাটি বিস্মৃত হইলেই বা চলে কেমন করিয়া? তাঁহারা বিলক্ষণ জানিবেন যে, ভারতীয় সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে ধর্মাচরণের অখণ্ড অধিকার দিয়াছে। পাশাপাশি, অন্যের অধিকারে বিঘ্ন না ঘটাইয়া নিজের ইচ্ছা অনুসারে বাঁচিবার অধিকারটি ভারতে মৌলিক। মুসলমান নাগরিকদের এই অধিকার রক্ষার দায় কি কোনও রাজ্যের সরকারই অস্বীকার করিতে পারে? গৈরিকপন্থীদের পাল্টা যুক্তিটি অনুমান করা চলে— মুসলমানরা প্রকাশ্যে নমাজ পড়িলে সেই সময় পথে যান চলাচলের অসুবিধা হয়; পার্ক-ময়দান ব্যবহার করিবার উপায় থাকে না। প্রশ্ন হইল, যে ধর্মাচরণের সহিত কৌমতা অঙ্গাঙ্গি, অর্থাৎ যে ধর্মের বিশ্বাসীদের নিকট সম্মিলিত প্রার্থনার মহিমা একক প্রার্থনার তুলনায় অধিক, তাঁহাদের ধর্মাচরণের অধিকারের সহিত পার্কে পদচারণার অবাধ অধিকারের তুল্যমূল্য বিচারে সরকার বা প্রশাসনের অবস্থান কী হইবে? কোন অধিকারটি তাহাদের নিকট গুরুতর বোধ হইবে? প্রশ্নটি, অনিবার্য ভাবেই, রাজনৈতিক। ধর্মনিরপেক্ষ উদার রাজনীতির সহিত সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতির সংঘাতের ক্ষেত্র রচনা করে এই প্রশ্নটি। খট্টর প্রত্যাশিত পক্ষই লইয়াছেন। নাগপুরের পাঠশালা এই শিক্ষাই দেয়।
বস্তুত, নরেন্দ্র মোদীর জমানা নাগপুরের শিক্ষাকেও অতিক্রম করিয়া ক্রমেই গোলওয়ালকরের আদর্শে উপনীত হইতেছে। যে ভঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যা-বারাণসীতে শিলান্যাস বা উদ্বোধন করিতেছেন, সেই মুদ্রারই অপর পৃষ্ঠে রহিয়াছে হরিয়ানা। গোলওয়ালকরের রাজনৈতিক কল্পনার হিন্দু ভারতকে খাতায়-কলমে না হইলেও কাজে প্রতিষ্ঠা করা গিয়াছে। এই দেশে মুসলমানরা এখন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক তো বটেই, রাষ্ট্রশক্তি এখন লজ্জাহীন ভাবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতেও হিন্দুত্ববাদীরা ছিল, যেখানে ক্ষমতা তাহাদের দখলে ছিল, সেখানে উগ্রতায় প্রশ্রয়ও ছিল— কিন্তু সেই ভারতে করসেবকরা ভাঙাভাঙি করিত, প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রশক্তি নহে। বর্তমান ভারতে কি তবে রাষ্ট্রই সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যেখানে সংবিধান-বর্ণিত দায়িত্বকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া হিন্দুত্বের প্রধান ধ্বজাধারী হইয়াছেন, সেখানে খট্টর প্রমুখ নেতাদের নিকট আর কী-ই বা প্রত্যাশা থাকিতে পারে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy