বিশ্ব জুড়িয়া খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ক্রমবর্ধমান। রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজ়েশন-এর এক সূচক অনুযায়ী, গত বৎসর জুলাইয়ে খাদ্যপণ্যের যা মূল্য ছিল, তাহার তুলনায় এই বৎসরের জুলাই মাসে খাদ্যপণ্যের সামগ্রিক মূল্যস্তরে বৃদ্ধি হইয়াছে ৩১ শতাংশ। এক দিকে অতিমারির ফলে বহু ক্ষেত্রেই উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হইয়াছে; অন্য দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাব, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেল, চিনি ও খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে হরেক দেশের নীতিবদলের ন্যায় নানাবিধ কারণ এই সমস্যাকে আরও জটিল করিয়াছে। খাদ্যদ্রব্যের এই মূল্যবৃদ্ধি ফিরাইয়া আনে ২০০৮ এবং ২০১১ সালের স্মৃতি, যখন এই কারণে আফ্রিকা ও এশিয়ার ত্রিশটিরও অধিক দেশে খাদ্য-দাঙ্গার সৃষ্টি হইয়াছিল। এবং, ‘আরব বসন্ত’-এর ন্যায় রাজনৈতিক অভ্যুত্থানেরও অন্যতম প্রত্যক্ষ কারণ ছিল খাদ্যপণ্যের বেলাগাম মূল্যস্ফীতি। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির একটি বিচিত্র বিপদ আছে— যে হেতু এই মূল্যস্ফীতি চরিত্রগত ভাবেই দীর্ঘমেয়াদি হয় না, এবং যে হেতু অল্প সময়ের মধ্যে ইহার প্রবল উঠা-পড়া ঘটে, ফলে স্বভাবতই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি শুধুমাত্র খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করিতে সচরাচর নিজেদের আর্থিক নীতি পাল্টায় না; এবং, না পাল্টাইবার ন্যায্য কারণ আছে। কিন্তু, তাহার ফলে যত ক্ষণ অবধি এই মূল্যস্ফীতি চলিতে থাকে, তাহার আঁচ সরাসরি পড়ে ক্রেতাদের উপর।
সাধারণত প্রোটিনযুক্ত খাবারের মূল্য সর্বাধিক হইয়া থাকে; কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাদ্য তুলনায় অনেক কম দামে মিলে। ফলে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিলে মানুষ স্বভাবতই কম দামি খাদ্যপণ্যের দিকে ঝুঁকেন। খাদ্যাভ্যাসে প্রোটিন, ভিটামিন ও বিবিধ পুষ্টিগুণসম্পন্ন অণুখাদ্যের মাত্রা কমিতে থাকিলে— তাহার প্রভাব পড়ে পরিবারের সদস্যদের উপরে। পৌষ্টিক আহারের ভারসাম্য নষ্ট হইয়া যায়। ইহার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর। সুষম আহার না পাইলে শিশুদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, তাহাদের মানসিক বিকাশ যথাযথ হইতে পারে না। কর্মক্ষমতায় ঘাটতি থাকিয়া যায়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও ঠিক ভাবে গড়িয়া উঠে না। এবং, এই অভিঘাত লিঙ্গ-নিরপেক্ষ নহে— পুরুষের তুলনায় নারীর উপর এই অপুষ্টির অধিকতর প্রভাব পড়ে। পুত্র এবং কন্যা সন্তানের মধ্যে যে বৈষম্য পুরুষতান্ত্রিক পরিবারব্যবস্থায় ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা, তাহাতে ছেলেদের পাতে যদিও বা কিছু উচ্চ গুণমানের খাদ্য পড়ে, মেয়েরা সেইটুকুতেও বঞ্চিতই থাকে। গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে এই বঞ্চনা অন্যতর সমস্যার সৃষ্টি করে— পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর আহার না পাইলে প্রসবের সময় তাঁহাদের জীবনসংশয় ঘটিতে পারে, অপুষ্ট শিশু জন্মগ্রহণ করে, পরিণামে শিশুমৃত্যুর হার বাড়িয়া যায়।
খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে অর্থশাস্ত্রের পরিসরে, বা নীতিনির্ধারকদের দুনিয়ায় যত আলোচনা হইয়া থাকে, তাহার সিংহভাগ জুড়িয়া থাকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা। তাহা স্বাভাবিকও বটে, কারণ এই বিপত্তির আঁচ সর্বাধিক পড়ে তাঁহাদেরই উপর। কিন্তু সমাজের অন্য স্তরের মানুষের জীবনেও খাদ্যপণ্যের বেলাগাম মূল্যস্ফীতি যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলিতে পারে, তাহার ফল গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি। পরিবারের আর্থিক সমৃদ্ধির সহিত খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিজনিত পুষ্টির ঘাটতির সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক, এবং এই ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদে মানুষের কেপেবিলিটি বা ‘স্ব-ক্ষমতা’কে প্রভাবিত করে— ফলে, এই ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক অসাম্যকে গভীরতর করিয়া তুলিতে পারে। কাজেই, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং সমাজের কী কর্তব্য, সেই বিষয়ে আলোচনাকে শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠী-কেন্দ্রিক না রাখাই বিধেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy