প্রতীকী ছবি।
গভীর হতাশায় শেষ হইতেছে ২০২১, না কি অর্থনৈতিক দুর্যোগের কৃষ্ণবর্ণ মেঘে চোখে পড়িতেছে দুই-একটি রুপালি রেখাও? সম্ভাবনা একেবারে অনুপস্থিত, এমন নহে, তবে সমস্যার পাল্লাই ভারী। আপাতদৃষ্টিতে, এই বৎসর ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার দুনিয়ায় অগ্রগণ্য। প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপির বৃদ্ধির হার ছিল কুড়ি শতাংশের ঊর্ধ্বে। কিন্তু ইহা পাটিগণিতের সত্য। অর্থনীতি পাটিগণিত নহে। অর্থনীতির সত্য: গত অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার আয়তন হ্রাস পাইয়াছিল ২৪ শতাংশ। সেই অতলের উপর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি ‘লো বেস এফেক্ট’-এর চরমতম উদাহরণ— খাদের তলদেশ হইতে দুই-তিনটি সোপান উপরে উঠিবার হিসাব। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার আট শতাংশের খানিক ঊর্ধ্বে দাঁড়াইয়াছে। খাদের পরিপ্রেক্ষিতে অতি সামান্য বৃদ্ধি। কিন্তু আরও উদ্বেগের কথা, এই সামান্য বৃদ্ধিও পরবর্তী ত্রৈমাসিকগুলিতে ধরিয়া রাখা যাইবে কি না, তাহা অনিশ্চিত। কারণ, অতিমারির বিপদের অপর পারে অন্য বিপদ দাঁড়াইয়া আছে।
তাহার নাম মূল্যস্ফীতি। গত সাত মাস যাবৎ ভারতে পাইকারি মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার দশ শতাংশের ঊর্ধ্বে। তাহার একটি কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি। অন্য কারণ কয়লার সঙ্কট, যাহার ফলে শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী। সেমিকন্ডাকটর চিপের জোগানে ঘাটতিও দেশের বাজারে প্রভাব ফেলিয়াছে। অন্য দিকে, অর্থব্যবস্থার ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ধারাবাহিক ভাবে সুদের হার কম রাখিয়াছে। ফলে, বাজারে নগদের যথেষ্ট জোগান রহিয়াছে, যাহা মূল্যস্ফীতির হারকে বাড়াইতে পারে। অধিকতর দুশ্চিন্তার কথা, দেশের বাজারে যদি মূল্যস্ফীতি চলিতেই থাকে, তবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হাতের এই আর্থিক নীতির অস্ত্রটি বহুলাংশে অকেজো হইয়া যাইবে। কারণ, অদ্যাবধি ব্যাঙ্কের ঘোষিত সীমার নীচে থাকিলেও খুচরা পণ্যের মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধি ক্রমেই বিপজ্জনক অভিমুখে চলিতেছে। এক দিকে বৃদ্ধির হারের গতিভঙ্গ, অন্য দিকে মূল্যস্ফীতির হারের ঊর্ধ্বগতি, উভয়ই প্রভাব ফেলিয়াছে দেশের সিংহভাগ মানুষের আয়ে, ক্রয়ক্ষমতায়। বৈশ্বিক আর্থিক অসাম্যের সূচক বলিতেছে, ভারতে অসাম্য অসহনীয় স্তরে পৌঁছাইয়াছে। ২০২১ সাল সাক্ষী থাকিল, অর্থনীতির দুইটি স্রোত— আর্থিক বৃদ্ধির গতিভঙ্গ ও লাগামহীন মূল্যস্ফীতি— কী ভাবে ক্রমে জনতাকে কোণঠাসা করিয়া ফেলিল।
এই অবস্থা শুধুই অতিমারির কারণে নহে। অতিমারি আরম্ভ হইবার পূর্বের চারটি বৎসর ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় এমন একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল, দেশ স্বাধীন হইবার পরে যাহা কখনও ঘটে নাই— টানা চার বৎসর আর্থিক বৃদ্ধির হার পূর্ববর্তী বৎসরের তুলনায় কম ছিল। অর্থাৎ, অতিমারির ধাক্কা না লাগিলেও ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বিপন্নই ছিল। এই বিপন্নতার মৌলিক দায় অতএব অতিমারির ঘাড়ে চাপাইয়া দেওয়া যাইবে না। সেই দায় অর্থব্যবস্থার কর্ণধারদের। পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থব্যবস্থার যে খোয়াব তাঁহারা দেখাইতেছিলেন তাহা অন্তঃসারশূন্য ছিল। অতিমারি আরম্ভ হইবার পূর্বে এবং পরে অর্থব্যবস্থা পরিচালনায় তাঁহাদের বহু সিদ্ধান্তই ভ্রান্ত ছিল। ২০২১ সাল তাহারই মাসুল গনিয়াছে। এই ব্যর্থতা হইতে নেতারা যদি আত্মম্ভরিতার বিপদের শিক্ষাটি গ্রহণ করেন; যদি বুঝেন যে, লোক ভুলাইবার কৌশলে অর্থব্যবস্থা পরিচালনা করা অসম্ভব, আগামী বাজেটে পরিকাঠামোয় সরকারি বিনিয়োগের হার বাড়াইয়া বেসরকারি বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে পারেন, পাশাপাশি অর্থনীতিবিদদের সুপরামর্শ মানিয়া জনমুখী ব্যয়বরাদ্দে প্রয়োজনীয় বৃদ্ধি ঘটাইতে পারেন, তবে হয়তো ২০২২ সুসংবাদ আনিতে পারে। নচেৎ, দুর্দশা দীর্ঘস্থায়ী হইবে, তেমন আশঙ্কা প্রবল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy