শাসক প্রাকৃতিক সম্পদকে সকলের করিয়া রাখিতে চাহেন না, পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করিয়া ক্ষমতা প্রদর্শন করিতে তৎপর হইয়া উঠেন। ফল? প্রকৃতির প্রতিশোধ মানব-সভ্যতার উপর নামিয়া আসিতে পারে। রবীন্দ্রনাথের কালে প্রকৃতি ও পরিবেশ লইয়া সচেতনতা সে-ক্ষণে তীব্র হইয়া উঠে নাই, প্রকৃতিবাদী রাজনৈতিক কর্মীরা এ-কালের ন্যায় সরব-তৎপর ছিলেন না, তথাপি তিনি প্রকৃতির গুরুত্ব ও সমস্যার মূলটি অনুধাবন করিয়াছিলেন। মুক্তধারা নাটকে জলসম্পদ কুক্ষিগত করিতে চাহিয়াছিল রাজশক্তি। প্রযুক্তিবিদের সহায়ে ‘মুক্তধারা’য় বাঁধ দেওয়া হইল। ফলে রাজার আপন রাজ্যের প্রজারা জল পাইলেও উপনিবেশের প্রজাদের জল বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। প্রকৃতির জল পাইতে হইলে কর প্রদান করিতে হইবে। এই রাজনৈতিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে সরব হইলেন ধনঞ্জয়— তিনি জননেতা। পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ মানুষকে জাগাইয়া তুলিলেন। গণ-আন্দোলন ব্যর্থ হইল না, মুক্তধারার বাঁধ মোচন সম্ভব হইল। রবীন্দ্রনাথের নাটকে প্রকৃতির প্রতিশোধের কিছু ইশারা ছিল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার দিনলিপি স্মৃতির রেখায় একাধিক স্থানে বহু-বৎসর পরবর্তী বিশ্বের চিত্র আঁকিয়াছিলেন। স্পর্ধিত নগর যেখানে ছিল, সেই ভবিষ্য-বিশ্বে তাহা জলের তলায়। নাগরিক স্পর্ধার চিহ্নমাত্র নাই। রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ কেহই প্রকৃতিকে জয় করিবার মূঢ়তা দেখান নাই, প্রকৃতির সহিত সহযোগের সম্বন্ধে বিশ্বাসী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ দুইজনেই ভাবিয়াছেন, প্রাকৃতিক সম্পদকে লাভের কড়ি করিয়া তুলিবার দুর্মর লোভ ত্যজনীয়। এই প্রকৃতিধ্বংসী লোভী ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে যদি লড়াই করিতে হয় তাহা হইলে সাধারণ মানুষকেই অগ্রসর হইতে হইবে, ধনঞ্জয়দের নেতৃত্বে অগ্রসর হইতে হইবে। সচেতনতার প্রসার লাগিবে।
সাহিত্যের ছবি যেন বাস্তবের কথাই এক রকম করিয়া বলিতে চাহে। বস্তুত সাহিত্য কেবল সমকালীন বাস্তবের কথা বলে না, সাহিত্যিক তাঁর দূরদৃষ্টি সহায়ে ভবিষ্যৎ বাস্তবকেও প্রকাশ করিতে পারেন। ভারত-ব্রিটেনের যৌথ উদ্যোগে গ্লাসগোয় পরিবেশ সম্মেলনে রাষ্ট্রনায়কেরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গৃহে বসিয়া পরিবেশ বিষয়ে উচ্চনাদী ভাষণ প্রদান করিতেছিলেন। তাঁহাদের সেই ভাষণ যে কথার কথা, আচরণের সত্য নহে বিশ্ববাসী তাহা জানেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যথারীতি সূর্যোপনিষদের দোহাই দিয়াছেন, বলিয়াছেন সূর্যের নিকট ফিরিতে হইবে। অস্যার্থ, সৌরশক্তির বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার বিধেয়। ভারতবাসী জানেন যাহা হইবার তাহাই হইবে। পরশুরামের ভণ্ড মহাপুরুষের ন্যায় এই দেশে হাস্যকর কাণ্ডাকাণ্ড ঘটাইবার জন্য হিন্দুত্ববাদীরা তৎপর হইবেন। পুঁজি ধর্ম, পুঁজি সত্য বলিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচারে অসরকারি সংস্থার নিকট বিক্রয় করিয়া দিবার পথ অনুসন্ধান করা হইবে। এই সমস্ত লোক-দেখানো কথার বাহিরে আর এক জনও সরব হইয়াছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনের নেতাদের বক্তৃতায় কান না-পাতিয়া তাঁহার কথায় কান দিলে লাভ বই ক্ষতি হইবে না। সুইডিশ পরিবেশ-কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ একটি উদ্যানে অন্য পরিবেশ-কর্মীদের সহিত জমায়েত হইয়াছিলেন। তাঁহার দাবি পরিবেশের নামে ‘হাবি-জাবি’ বলা বন্ধ করিতে হইবে। যথার্থ লিমুজ়িন চাপিয়া আসিয়া ঠান্ডাঘরে বসিয়া পরিবেশ রক্ষার কথা বলা সম্পূর্ণ অর্থহীন। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি ও তাঁহারা মনে করাইয়া দিয়াছেন— সত্যকারের পরিবেশ-কর্মী কিন্তু নেতাদের মধ্য হইতে জাগিয়া উঠেন না। সাধারণ মানুষই প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষাকারী যথার্থ নেতা।
সার সত্য— যদি প্রকৃতিকে বাঁচাইতে হয় ও মানব-সভ্যতাকে রক্ষা করিতে হয়, তাহা হইলে কথা নয়, কাজে বিশ্বাস করিতে হইবে, এবং সে কাজ সকলের। কেবল নেতারা তাহা করিতে পারিবেন না। প্রকৃতি কিন্তু যথার্থ সাম্য-বিধায়ক শক্তি। সূর্যালোক যেখানে পড়ে, সেখানে ধনী-দরিদ্রের ভেদ নাই, ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহারার পার্থক্য নাই। নেতাদের বুঝিতে হইবে আমরা সকলেই প্রকৃতির এক বৃহৎ নৌকায় রহিয়াছি। নৌকা ডুবিলে সকলেই ডুবিবে। এখানে উচ্চ-নীচের অহমিকা প্রকাশ করা কেবল অর্থহীন নহে, মূঢ়তাও বটে। মানসিকতা ও জীবনাচরণ বদল করা অতীব জরুরি, নতুবা প্রকৃতি যে কত বড় প্রতিশোধ লইতে পারে, তাহার কিছু নিদর্শন এখনই স্পষ্ট। যেটুকু সময় হাতে রহিয়াছে, তাহার সুব্যবহার করিলে হয়তো মানব-সভ্যতা বৃহত্তর বিপর্যয় হইতে রক্ষা পাইবে, এই আশাই কিন্তু সম্বল।
যৎকিঞ্চিৎ
এই দেশ মোস্ট ফেভার্ড নেশন, ওই দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তি— এ সব এখন অতীত। কোনও দেশকে বেরাদর বলে জড়িয়ে ধরার প্রকৃষ্টতম পন্থা হল সেই দেশের সঙ্গে ট্রাভেল করিডর তৈরি করে ফেলা। গোটা দুনিয়ার লোকের জন্য এক নিয়ম, ট্রাভেল করিডরের দোসরের সঙ্গে আর এক— সটান দেশে ঢুকে পড়তে কোনও বাধা নেই। কূটনৈতিক দুনিয়ায় নতুন দুশ্চিন্তা: কে কার বাব্ল থেকে বাদ পড়ে গেল, আমার শত্রুর বাব্লে ঢুকে পড়ল কোন দেশ। বাব্ল মোরা যেন বন্ধুহীন না হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy