শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভে ইতি টানিলেন কৃষকরা। প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিত কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহার করিয়া লইবার তিন সপ্তাহ পর। পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বেই যে কৃষকরা দিল্লির সীমান্ত হইতে ডেরাডান্ডা তুলিয়া লইলেন, ইহা নিশ্চিত ভাবেই খিড়কির দরজার রাজনীতিতে বিজেপির প্রতিভার স্বাক্ষর। কৃষকরা জানাইয়াছেন, ইহা যুদ্ধবিরতি মাত্র— সরকার নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করিলে তাঁহারা ফের পথে নামিবেন। কথাটিকে কী ভাবে দেখা সঙ্গত— আন্দোলন চালাইয়া যাইবার হুমকি দিবার পরও তাহা গুটাইয়া লইবার ফলে মুখরক্ষার মরিয়া প্রয়াস, না কি কোনও দাবিতে সত্যই তাঁহারা ফের পথে নামিতে পারেন? রাজনীতির চলনের পূর্বাভাস করা অনর্থক, কিন্তু এমন একটি দাবি কৃষকদের রহিয়াছে, যাহা পঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশ বলয়ে ফের বড় মাপের বিক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। সেই দাবিটি মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি), অর্থাৎ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা প্রদান করিয়া আইন প্রণয়নের। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হইল ধান, গম, তুলা-সহ মোট ২৩টি কৃষিপণ্যের জন্য সরকার-নির্ধারিত মূল্যস্তর, বাজারদর যাহার তুলনায় কম হইলে সরকার সেই নির্দিষ্ট দামে কৃষকদের হইতে বাজারজাত উৎপন্ন ফসল কিনিয়া লইবে। যদিও তালিকায় ২৩টি ফসলের নাম রহিয়াছে, এই সুবিধাটি উদাহরণ হিসাবে উপরে উল্লিখিত তিনটি ফসলের মধ্যেই কার্যত সীমাবদ্ধ।
স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয় যে, এমএসপি-র আইনের দাবি সর্বভারতীয় নহে। পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের ন্যায় মুষ্টিমেয় রাজ্যের বৃহৎ কৃষকরা এই ব্যবস্থায় লাভবান হন। খেয়াল করিলেই স্পষ্ট হইবে যে, তাঁহারাই এমএসপি-র নিশ্চয়তার দাবিতে অনড়। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ প্রশ্ন করিয়াছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত আইন চালু করেন নাই? উত্তর সহজ— এই রাজ্যে তাহার গুরুত্ব নাই। এই কথাটি বাদ রাখিলেও এমএসপি-র নিশ্চয়তার দাবিটি বহু মাত্রায় অন্যায়। প্রথমত, আইন বাঁধিয়া যদি সরকারকে সব ফসল এমএসপি-র দরে কিনিতে হয়, তবে তাহা রাজকোষের উপর বিপুল চাপ তৈরি করিবে। কেহ কেহ ইহাকে ‘দেউলিয়া হইবার সহজ পথ’ বলিয়াও চিহ্নিত করিয়াছেন। দ্বিতীয়ত, এই খরিদ্দারি সরকারি গুদামে বিপুল উদ্বৃত্ত তৈরি করে। তৃতীয়ত, দামের নিশ্চয়তা ভারতীয় কৃষিকে প্রতিযোগিতায় অপারগ করিবে। চতুর্থত, এমএসপি-র ব্যবস্থা কৃষি উৎপাদনের ভারসাম্য নষ্ট করে। নিশ্চিত মূল্যের আকর্ষণে কৃষকরা চাল ও গমের উৎপাদনে জোর দেওয়ায় অন্যান্য ফসল প্রয়োজনের তুলনায় কম উৎপাদিত হয়। শেষ পর্যন্ত তাহা আমদানি করিতে হয়।
কৃষির ভারসাম্য বিনষ্ট হইবার বৃহত্তর বিপদ পরিবেশগত। পঞ্জাবের উদাহরণটি দেখিলেই তাহা স্পষ্ট হইবে। এমএসপি-র প্রথা চালু হইবার পূর্বে, ষাটের দশকেও পঞ্জাবে অতি সামান্য পরিমাণ ধান উৎপন্ন হইত। তাহা যুক্তিসঙ্গতও বটে। ধান চাষের জন্য প্রচুর জল প্রয়োজন— পঞ্জাবের মাটিতে সেই জলের সংস্থান ছিল না। কিন্তু এমএসপি-র আকর্ষণে পঞ্জাবে ক্রমেই ধানের উৎপাদন বাড়িয়াছে— এখন সেই রাজ্যে মোট উৎপন্ন ফসলের চল্লিশ শতাংশের অধিক ধান। তাহাতে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের সর্বনাশ হইয়াছে। অন্য দিকে, ষাটের দশকে সেই রাজ্যের মোট উৎপাদনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ছিল বিভিন্ন ডাল— যে ফসল জমির উর্বরতা বাড়ায়। এখন সেই উৎপাদন প্রায় শূন্য। এই ভারসাম্যহীনতার একমাত্র কারণ এমএসপি। কৃষকের ন্যায্যতর মূল্যে অধিকার অনস্বীকার্য। কিন্তু, তাহার প্রকৃত পথ— কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার— সরকার মারিয়া রাখিয়াছে। এমএসপি-র দাবিটি লইয়া কৃষকরা বাকি ক্ষতিটুকু করিয়া ফেলিবেন, সেই আশঙ্কা প্রবল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy