সেই অসম্ভব সম্ভব হইয়াছে আজ— বাংলাদেশ। একটি জাতি জাত হইয়াছিল আগেই, আজ সে মুক্ত, সর্ব-অর্থে স্বাধীন। ধর্ম নয়, ভাষা ও সংস্কৃতিকে আশ্রয় করিয়া একটি দেশ, একটি জাতি বিশ্বে আত্মপ্রতিষ্ঠা করিয়াছে।”— পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশকে অভিনন্দন ও অভিবাদন জানাইয়া এই পত্রিকা সমগ্র বঙ্গভাষী সমাজের হৃদয়ের কথাই ঘোষণা করিয়াছিল। যথার্থ স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করিতে পূর্ববঙ্গের নাগরিকদের মরণপণ লড়াইয়ের শেষে বহু প্রাণের মূল্যে শেষ অবধি যখন বাংলাদেশ এক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, সেই মুহূর্তটির সম্যক তাৎপর্য উপলব্ধি করা সহজ নহে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস হইতে মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত অভিজ্ঞতার শেষে ১৬ ডিসেম্বরের উপলব্ধির কথা জানাইতে গিয়া সম্প্রতি প্রয়াত অনন্য লেখক হাসান আজিজুল হক লিখিয়াছিলেন, “যদি কোটি মানুষের শোক আমি একা আমার এই বুক থেকে খালাস করে দিতে পারতাম, যদি পুরো একটি আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতে কষ্টের শোকের ক্ষোভের ক্রোধের আক্রোশের উচ্ছ্বাস আমার একার বুক ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারত, যদি লক্ষ মানুষের অশ্রু আমার দুখানি চোখ থেকে মুক্তি পেত, তাহলে হয়তো খানিকটা ন’মাসের অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যেত।” সাহিত্যস্রষ্টার লেখনীতে উৎসারিত এই আর্তিতে বাংলাদেশের জন্মবেদনার অমলিন স্বাক্ষর রহিয়াছে।
বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাসও অনেকখানি বেদনার। স্বাধীনতার চার বৎসরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড কেবল সেই ইতিহাসের এক মর্মান্তিক মুহূর্ত নহে, তাহার অন্ধকার দিকটির অনন্য প্রতীকও বটে। যে ধর্মাশ্রিত সাম্প্রদায়িকতার আধিপত্যকে অস্বীকার করিয়া এবং চূর্ণ করিয়া উদার ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের পথে শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের যাত্রা শুরু, দেশের ভিতরে তাহার প্রতিপত্তি সেই আদিপর্বেই কম ছিল না। দেখিতে দেখিতে সেই বিদ্বেষের কারবারিরা নূতন রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আপন কুচক্রের জাল বিস্তার করে। বঙ্গবন্ধুর বিদায়ের পরে বাংলাদেশ দ্রুত অন্ধকারের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়, যে অন্ধকার হইতে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজিয়া লইতে তাহার বিস্তর সময় লাগিয়াছে। সেই পথ অত্যন্ত কঠিন ছিল। এবং আজও অন্ধকার সম্পূর্ণ দূর হইয়াছে, এমন কথা বলিবার কোনও অবকাশ নাই। সাম্প্রদায়িকতার শক্তি এখনও সুযোগ খুঁজিতেছে, অস্ত্র শাণাইতেছে, তাহার আক্রমণও থামিয়া নাই। বাংলাদেশের অন্দরের সংগ্রাম এখনও অব্যাহত।
কিন্তু সেই সংগ্রামে জয়ী হইয়া আলোর পথে আপন যাত্রাকে অব্যাহত রাখিবার প্রত্যয়ের কোনও অভাব এই প্রতিবেশী দেশটির নাই। কেবল সরকারে নহে, দেশের সমাজেও উদার ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা আজ প্রবল, এবং তাহার প্রেরণায় সাম্প্রদায়িকতার অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখিবার সঙ্কল্পও অবিরত নিজেকে প্রমাণ করিয়া চলিয়াছে। কী ভয়ানক প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়াইয়া সেই দেশের উদার গণতান্ত্রিক নাগরিকদের লড়াই চালাইতে হয়, তাহা ভাবিলে যুগপৎ বিস্ময় এবং শ্রদ্ধার অনুভূতি না জাগিয়া পারে না। মনে রাখিতে হইবে, এই প্রত্যয় ও সামর্থ্যের পিছনে রহিয়াছে এক অসামান্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাফল্য, যাহার ফলে পঞ্চাশ বৎসর পূর্বের অতি দরিদ্র এবং অশক্ত একটি অর্থনীতি আজ কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নহে, উন্নয়নশীল দুনিয়াতেও বন্দিত হইতেছে। বিশেষত জনস্বাস্থ্য এবং মেয়েদের আর্থিক ও সামাজিক ক্ষমতা অর্জনের মাপকাঠিতে তাহার অগ্রগতি আক্ষরিক অর্থে জগৎসভায় স্বীকৃত। বাংলাদেশ এখনও দরিদ্র, তাহার অর্থনীতি আজও বহুলাংশে অনগ্রসর, অনেক পথ তাহাকে যাইতে হইবে। কিন্তু তাহার প্রথম ও প্রধান ভরসা সে নিজে। এই ভরসাই তাহার ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অর্জন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy