Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Lynching

কাহার জয়

অপমানিত পিতার মুখে যে ত্রস্ত ও করুণ জয়ধ্বনি শুনা গেল, তাহা আসলে কাহার জয়, শিশুসুলভ সেই প্রশ্নের উত্তর আজিকার ভারতে নাই।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২১ ০৫:২০
Share: Save:

মন্দ মানুষটির মাথা মুড়াইয়া, মুখে চুনকালি মাখাইয়া, গাধার পিঠে চড়াইয়া রাজ্যের বাহিরে দূর করিয়া দিতে দেখা যাইত রূপকথার শেষে। কানপুরের শিশুকন্যাটি সেই রূপকথা পড়িয়াছে কি না জানা নাই, কিন্তু রূপকথাতেও যে নিষ্ঠুরতা অকল্পনীয়, তাহাই সে ঘটিতে দেখিল বাস্তবে, চোখের সম্মুখে, নিজের পিতার সহিত। আর তিরবেগে ছড়াইয়া পড়া ভিডিয়োয় সমগ্র ভারত দেখিল, মুসলিম রিকশাচালককে মারধর ও চরম হেনস্থা করিয়া, তাঁহাকে জোর করিয়া ‘জয় শ্রীরাম’ বলাইতেছে কিছু মানুষ, তাঁহার শিশুকন্যাটি কখনও কাঁদিয়া হেনস্থাকারীদের পায়ে পড়িতেছে, কখনও ভয়ে পিতাকে জড়াইতেছে। শিশুর কাতর অনুনয়েও প্রহার থামে নাই, পরে পুলিশ আসিয়া লোকটিকে উদ্ধার করিয়াছে।

উত্তর ভারতে মানুষে মানুষে সৌজন্য-সাক্ষাতের মৃদু ও মধুর ‘রাম রাম’ বা ‘জয় সিয়ারাম’ কবে কোন উপায়ে উন্মত্ত ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে পাল্টাইয়া গেল তাহা সমাজতাত্ত্বিকরা বলিবেন, কিন্তু আসল কথা, এই ভারতে উহা আর নিছক শব্দমাত্র বা রাজনীতির স্লোগান নহে, পীড়নের অব্যর্থ অস্ত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ক্ষমতার রাজনীতি যে জিনিসগুলির ঢালাও অনুমোদন দিয়া থাকে, তাহার অন্যতম এই পীড়নের অধিকার, হেনস্থার ছাড়পত্র। বিগত কয়েক বৎসরে উত্তরপ্রদেশ হইতে অসম, দিল্লি, রাজস্থান— সংবাদমাধ্যমে একের পর এক ঘটনা উঠিয়া আসিয়াছে, যেখানে শাসক বিজেপি ও আরএসএস-বজরং দলের কর্মী সদস্য বা সমর্থক সাধারণ মানুষও ভিন্নধর্মী মানুষের উপর চড়াও হইয়াছেন; মারধর করিয়া, জোর করিয়া ‘জয় শ্রীরাম’ বলাইতেছেন। ২০১৯-এর জুনে ঝাড়খণ্ডে তাবরেজ় আনসারির ঘটনা এখনও খুব পুরাতন হয় নাই— হাত বাঁধিয়া, লাঠি দিয়া পিটাইয়া তাঁহাকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো হইয়াছিল, গুরুতর আহত মানুষটি কয়দিন পরে মারা গিয়াছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি ছক পরিষ্কার: ভিন্নধর্মী মানুষটির বিরুদ্ধে গোড়ায় কোনও অভিযোগের ধুয়া তোলা— যেমন তাবরেজ়ের ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চুরি, কানপুরে রিকশাচালকের পরিচিত এক মুসলিম পরিবারের বিরুদ্ধে ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ— পরে দলবল লইয়া হেনস্থা ও অত্যাচার। ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো এই পুরা প্রক্রিয়াটির অঙ্গ— পীড়ন ও আমোদের বীভৎস অভিজ্ঞান।

সংবিধান-স্বীকৃত নিজ ধর্মবিশ্বাস বা মতাদর্শ পালনের অধিকার যে এই রূপ প্রতিটি ঘটনায় ভূলুণ্ঠিত হইতেছে, ধূলিসাৎ হইতেছে শাশ্বত ভারতেরই মূল্যবোধ, সেই কথা মুহুর্মুহু বলিয়াও কাজ হইতেছে না, কারণ শাসনক্ষমতার শীর্ষে বিরাজিত অটল মৌন। তাহাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরিয়া সংসদ হইতে সমাজ, সর্বত্র একই কুনাট্য চলিতেছে। তাই নেতাজির জন্মবার্ষিকী পালনের ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে বা লোকসভায় বিরোধী সাংসদদের শপথগ্রহণের সময়েও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি, আবার ঝাড়খণ্ড বা কানপুরে একা অসহায়কে বাগে পাইয়াও তাহাই জোর করিয়া বলাইয়া লওয়া। একই উদগ্র উচ্চারণ— কোথাও রসিকতাছলে, কোথাও ক্ষমতার বলে। কানপুরের শিশুটি চোখের সম্মুখে যাহা দেখিল, তাহা দুরপনেয় ভয়ঙ্কর স্মৃতি হইয়া থাকিবে। তাহার অপমানিত পিতার মুখে যে ত্রস্ত ও করুণ জয়ধ্বনি শুনা গেল, তাহা আসলে কাহার জয়, শিশুসুলভ সেই প্রশ্নের উত্তর আজিকার ভারতে নাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Lynching Kanpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy