ছবি: পিটিআই।
এই বাজেট যে রাজনীতির হবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল না। নির্মলা সীতারামন হতাশ করেননি। যে ভঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতির প্রশ্নগুলিকে রাজনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, এই বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ঠিক তা-ই করেছেন। এই বক্তৃতার বৈশিষ্ট্য কী, এই প্রশ্ন করলে উত্তর হবে, আত্মবিশ্বাস। নির্মলা সীতারামনের বক্তৃতা কার্যত বলেই দিল যে, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা তৃতীয় দফা সরকার গড়বেন, সে বিষয়ে তাঁদের মনে সংশয়ের অবকাশ নেই। অর্থমন্ত্রী জানালেন, নতুন সরকার গঠনের পর তাঁরা যে বাজেটটি পেশ করবেন, তাতে ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার বিস্তারিত পথনির্দেশ থাকবে। ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে বর্তমানের অন্ধকার ঢাকতে ব্যবহার করার কৌশলটি সফল ভাবে পরীক্ষিত— তার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, সেই ভবিষ্যতে পৌঁছনোর পরে প্রতিশ্রুতি মিলিয়ে দেখার কথা কারও বিশেষ মনে থাকে না। যেমন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতির ক’আনা পূরণ হল, সে হিসাব আর কেউ করেন না। ২০৪৭ তো আরও অনেক দূরের কথা। কিন্তু, সরকার গড়ে দূর ভবিষ্যতের পথনির্দেশ দেবেন, অর্থমন্ত্রীর এই বার্তাটি তাঁদের আত্মবিশ্বাসের পরিচায়ক নয়। এই বাজেটে কার্যত কোনও নতুন প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, কোনও ‘রেউড়ি’-র ব্যবস্থা না করে শুধুমাত্র গত দশ বছরের কৃতিত্বের তালিকা সাজানোর মধ্যে নিহিত আসল বার্তাটি— তা এই যে, দশ বছরে যা করা হয়ে গিয়েছে, নির্বাচনে জিতে আসার জন্য সেটাই যথেষ্ট; নতুন কিছুর প্রয়োজন নেই।
কেউ কেউ বলবেন, এটা আত্মবিশ্বাস নয়, বরং কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করার ঔদ্ধত্য। কথাটি তাঁরা একই সঙ্গে ঠিক এবং ভুল বলবেন। এটা বিলক্ষণ কাউকে তোয়াক্কা না করার ভঙ্গি— এমনকি, সত্যেরও তোয়াক্কা না করা। অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে ‘তখন বনাম এখন’-এর একটি তুলনা টানলেন, ইউপিএ আমলের সঙ্গে বর্তমান আমলের। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বাস্তব সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, এমন ব্যক্তিমাত্রেই জানবেন যে, এটা কোনও তুলনাই নয়। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে উজ্জ্বলতম বছরগুলি হল ২০০৩ থেকে ২০১১— কার্যত পুরোটাই ইউপিএ জমানা— যখন ২০০৭-এর বৈশ্বিক মন্দার বছরটি বাদে আর্থিক বৃদ্ধির হার ধারাবাহিক ভাবে ৮ শতাংশের বেশি ছিল। এবং, ১৯৯১-পরবর্তী পর্যায়ে শ্লথতম বৃদ্ধির দশকটি হল নরেন্দ্র মোদীর শাসনকাল। যা কোনও মতেই নয়, তাকেই ‘হয়’ বলে চালানোর মধ্যে বেপরোয়া ঔদ্ধত্য বিলক্ষণ আছে। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন: মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার আগে অর্থব্যবস্থা পরিচালনায় কী কী ভুল ছিল, সে বিষয় তাঁরা শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। অর্থনীতির বাস্তবকে রাজনীতির কোন মোচড় দিয়ে তাঁরা পেশ করেন, তা দেখার বস্তু হবে নিশ্চয়ই।
দিল্লীশ্বররা জানেন, ইদানীং মানুষের এমনটাই পছন্দ। এক দিকে রামমন্দিরের বাস্তব, আর অন্য দিকে সাত ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার খোয়াবনামা— এই মিশেলের কোনও মার নেই। অর্থমন্ত্রীর ভাষণে এমন একাধিক প্রসঙ্গ রয়েছে, প্রকৃত প্রস্তাবে যা অতি তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, গরিব-যুব-অন্নদাতা-নারীকে চারটি ‘জাত’ হিসাবে দেখালে অস্বীকার করা যায় মনুবাদী সমাজব্যবস্থার যাবতীয় বাস্তব, যাবতীয় শোষণ ও বঞ্চনা। যেমন, বিনিয়োগের পরিমাণ না বাড়লেও কর্পোরেট করের নিচু হার অপরিবর্তিত রেখে দিলে অর্থনীতির যাবতীয় যুক্তিতে অস্বীকার করেই সাঙাততন্ত্রের উপকারসাধন করা যায়। অর্থমন্ত্রীর ভাষণে এই কথাগুলি এসেছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এক ঘণ্টার সামান্য কম সময়ের ভাষণে বিরোধী বেঞ্চ থেকে শোনা গেল না একটিও শব্দ, এমনকি এই কথাগুলির সময়ও নয়। তার কারণ কি এটাই যে, অর্থমন্ত্রীর মতো বিরোধীরা দেওয়াল লিখন পড়ে নিয়েছেন? শব্দ এবং নীরবতা, দুই-ই কি একই কথা বলল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy