‘মৃত্যু অবধি ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া’ একটি ‘নিষ্ঠুর এবং বর্বর’ ব্যবস্থা। প্রতীকী ছবি।
একটি ‘মানবিক, ত্বরিত এবং সুষ্ঠু’ বিকল্পের আর্জি জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন এক আইনজীবী। কিসের বিকল্প? ফাঁসির। ভারতের ফৌজদারি দণ্ডবিধি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার একমাত্র নির্ধারিত পন্থা হল ‘মৃত্যু অবধি ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া’। ওই আইনজীবীর মতে, এটি একটি ‘নিষ্ঠুর এবং বর্বর’ ব্যবস্থা, তাই চরম দণ্ডে দণ্ডিতের প্রাণ হরণের বিকল্প ব্যবস্থা চাই। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি পি এস নরসিংহ এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রাসঙ্গিক তথ্য ও মতামত সংগ্রহ করতে বলেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ফাঁসির পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড রূপায়ণের অন্য প্রকরণগুলি কতটা বিজ্ঞানসম্মত এবং নির্ভরযোগ্য, শরীর ও মনের উপর তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন, মানুষের মর্যাদার সঙ্গে তারা কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ, এমন নানা বিষয়ে তুলনামূলক বিচার না করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থির করা চলে না। সেই বিচারের জন্য আদালতের হাতে যথেষ্ট তথ্য চাই, বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বর্তমান অবস্থা সাপেক্ষে এই সব তথ্য জানা দরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতিরা সরকারকে বলেছেন— প্রয়োজনে আইনজ্ঞ, চিকিৎসাবিদ এবং বিজ্ঞানীদের নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করা যেতে পারে।
মৃত্যুদণ্ড অতি প্রাচীন প্রথা, কিন্তু তার ‘মানবিক’ উপায়ের ধারণাটি অর্বাচীন। দুনিয়ার নানা দেশেই প্রাণদণ্ড কার্যকর করার বহু নৃশংস প্রথা দীর্ঘকাল চালু ছিল। পাথর ছুড়ে মারা থেকে শুরু করে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেওয়া বা চার পাশে দেওয়াল গেঁথে দেওয়া, চারটি ঘোড়ার সঙ্গে চার হাত-পা বেঁধে দিয়ে ঘোড়াগুলিকে দৌড় করানো, ফুটন্ত তেলে ডুবিয়ে মারা— নিছক বিবরণগুলিই রীতিমতো অসহনীয়। আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রণেতা এবং পরিচালকদের বিবেচনায় অপরাধীকে যন্ত্রণা দেওয়াই ছিল প্রাণদণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য, যাতে লোকে সেই যন্ত্রণার ভয়ে অপরাধ থেকে বিরত থাকে। এই যুক্তিতেই বহু দর্শকের সামনে দণ্ডিতকে মারার আয়োজন হত। অনেক দেশেই সমাজের মনে সেই ধারণা আজও রীতিমতো জোরদার— অপরাধীকে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করার সওয়াল বিস্তর শোনা যায়। কোথাও কোথাও তেমন আয়োজন এখনও হয়। তবে তা ব্যতিক্রম। আধুনিক পৃথিবীতে, অন্তত নীতিগত ভাবে, যন্ত্রণা দিয়ে প্রাণসংহারকে দণ্ড বা শাস্তি বিধানের প্রকরণ হিসেবে গণ্য করা হয় না, প্রাণেরসংহার তথা জীবনের অবসানকেই চরমতম শাস্তি হিসাবে যথেষ্ট বলে মনে করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের অনুজ্ঞাটিও এই পরিবর্তিত ধারণার অনুসারী।
ফাঁসি ছাড়াও মৃত্যুদণ্ডের কয়েকটি প্রকরণ এখন কিছু কিছু দেশে ব্যবহার করা হয়। যেমন ‘বৈদ্যুতিক চেয়ার’, প্রাণঘাতী রাসায়নিক ইনজেকশন, ফায়ারিং স্কোয়াড, এমনকি শিরশ্ছেদ। নাইট্রোজেন গ্যাসের সাহায্যে জীবনীশক্তি বিনাশের নতুন প্রযুক্তি নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। এই বিভিন্ন বিকল্পের ‘সাফল্যের হার’ এক নয়, যন্ত্রণার মেয়াদ এবং তীব্রতার মাত্রাতেও তারতম্য আছে, এক নয় মানসিক প্রতিক্রিয়াও। সুতরাং, আদালত যে কাজ সরকারকে দিয়েছে, তা অত্যন্ত জটিল। প্রকৃত অর্থেই তা বিশেষজ্ঞদের কাজ। তবে এই সূত্র ধরেই উঠে আসে গভীরতর প্রশ্নটি: মৃত্যুদণ্ডের ধারণাটি কি মূলত অমানবিক নয়? আইনজীবীর সংশ্লিষ্ট আবেদনটিতে এই প্রশ্ন তোলা হয়নি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও সঙ্গত কারণেই তা বিবেচনার বাইরে রেখেছেন। মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্কের টানাপড়েন দীর্ঘকাল ধরেই চলছে, দুনিয়ার বহু দেশেই এই দণ্ড ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে, অন্য অনেক দেশে বাতিল না হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ বিরল। সেই তর্ক এখানে আলোচ্য নয়, কিন্তু শুধুমাত্র মানবিকতার মাপকাঠিতে মৃত্যুদণ্ড রূপায়ণের বিভিন্ন প্রকরণের তুলনামূলক বিচার করতে বসলেও ওই গভীরতর প্রশ্নটির ছায়া পড়তে বাধ্য। মানবিক ভাবে প্রাণ সংহার করা কি আদৌ সম্ভবপর? উত্তর দুর্জ্ঞেয়। হয়তো শেষ অবধি প্রশ্নটিকেই ঈষৎ অন্য ভাবে পেশ করে বলতে হবে: প্রাণ সংহারের কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে কম অমানবিক? প্রসঙ্গত, অষ্টাদশ শতকের শেষে গিলোটিনের আবিষ্কর্তা জোসেফ ইনিয়াস গিয়োতাঁ সগর্বে বলেছিলেন, তাঁর যন্ত্রটিতে মাথা কাটা পড়বে নিমেষের মধ্যে, যার মুণ্ডচ্ছেদ হল সে টেরও পাবে না! এই আশ্বাস যত ভয়ানকই শোনাক, সেই সময় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিতের মাথা কেটে নেওয়ার যে ব্যবস্থাগুলি চালু ছিল, তাদের তুলনায় গিলোটিন অনেক বেশি মানবিক বলে প্রতিপন্ন হয়। সত্য সে যে সুকঠিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy