প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
মহাভারত পড়েছেন কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী? শরশয্যাশায়ী ভীষ্ম রাজধর্ম, রাজ-আচরণ নিয়ে যে উপদেশ দিয়েছিলেন ‘রাজা’ যুধিষ্ঠিরকে, তা কি জানা আছে তাঁর? অন্তত হাটের মাঝে তাঁর সাম্প্রতিক ‘রসিকতা’র উদাহরণটি তা বলছে না। রাজা তথা শাসক হবেন মানুষের প্রতি সংবেদনশীল, সমবেদনাপূর্ণ; তিনি সদয় শব্দ বলবেন, পরুষ বাক্য নয়— শান্তিপর্বের পাতা ওল্টালেই তিনি দেখতে পেতেন। দেখতে পেতেন সেখানে লেখা, শাসক এমন কাজ করবেন, এমন কথা বলবেন যাতে কেউ আঘাত না পায়— শত্রুর কথা ভিন্ন। অনস্বীকার্য যে, নরেন্দ্র মোদী রাজা নন, কিন্তু ১৪২ কোটি জনতার অভিভাবক তো বটে? অথচ তিনি কি তা-ই করলেন না, জন-অভিভাবকের কাছে যা অনভিপ্রেত? ভরা অনুষ্ঠানে ভাল হিন্দি বলা প্রসঙ্গে টেনে আনলেন রসিকতা: অধ্যাপকের মেয়ে ‘সুইসাইড নোট’ লিখে রেখে বাড়ি ছেড়েছে, অধ্যাপক তা হাতে পেয়ে ভুল হিন্দি বানান ধরতে ব্যস্ত রইলেন। সে রসিকতায় সভাকক্ষ হাসল, তিনি নিজেও হাসলেন, কিন্তু এই কি হাসির বিষয়?
রসিকতা ঠিক-বেঠিকের ধার ধারে না, অষ্টপ্রহর যাথার্থ্য মেপেজুখে ঠাট্টা করলে তা রসিকতা থাকে না— যুক্তি হিসাবে এগুলি পেশ করার আগেও ভেবে দেখার, কে সেই রসিকতা করছেন। চা-দোকান বা লোকাল ট্রেনে কানে-আসা জন-রসিকতা আর ভরা অনুুষ্ঠানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ঠাট্টায় প্রভেদ প্রথমত স্থান কাল ও অবশ্যই পাত্রের, এবং দ্বিতীয়ত তার উপজীব্যের। আত্মহত্যা আর যা-ই হোক ঠাট্টা-তামাশার বিষয় নয়; কখনও, কোনও শর্তে বা পরিস্থিতিতে হতে পারে না— এটি বুঝতে সাধারণ মানবিক শিক্ষা ও কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। সেই কাণ্ডজ্ঞানই বলে দেয়, আত্মহত্যার ছায়া যে ঠাট্টায় তা রসিকতা নয়, বীভৎসতা। সেই বীভৎস অসংবেদনশীলতার প্রমাণ দিচ্ছেন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী, এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য কি আর কিছু হতে পারে? দেশের অভিভাবক হিসাবে তাঁর জানা উচিত জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র দেওয়া তথ্য: ২০২১-এ ভারতে আত্মহত্যা করেছেন ১,৬৪,০৩৩ জন, অর্থাৎ রোজ প্রায় সাড়ে চারশো মানুষ। এঁদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আঠারো থেকে ত্রিশ বছর বয়সি।
যে বিষয় নিয়ে জনসমক্ষে সংবেদী আলোচনা, সহমর্মিতায় পাশে দাঁড়ানো দরকার, তা নিয়ে চটুল ঠাট্টা আসলে উপহাসকারীর চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতারই প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রী এ-হেন প্রমাণ আগেও দিয়েছেন, আইআইটি-র অনুষ্ঠানে ‘ডিসলেক্সিয়া’য় আক্রান্তদের প্রসঙ্গ ব্যবহার করে ঠাট্টা ছুড়ে দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতার উদ্দেশে। সে দিনও উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে হাসির রোল উঠেছিল, এ দিনও উঠেছে। এ কোন নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতার দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তা অন্য সমাজমনস্তাত্ত্বিক আলোচনা। তবে যে দেশে নেতা নিজেই অসংবেদনশীলতার প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেন, সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্ক হয়। সময়ই কি বেছে নেয় রাজা কেমন হবেন, না কি রাজার কাজই ঠিক করে দেয় সময় কেমন যাবে— শান্তিপর্বে এই প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম বলেছিলেন, কোনও সন্দেহ নেই, রাজার কারণেই সময় ভাল বা মন্দ দিকে গড়ায়। আজকের ভারত সেই কদাচরণের সাক্ষী। শুধু বিরোধী দলের রাজনীতিক থেকে বিশিষ্টজন, সাধারণ নাগরিকও এই রসিকতার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, সেটুকুই আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy