Advertisement
২৪ অক্টোবর ২০২৪
hawkers

আইনের পুনর্বাসন

রাস্তার হকারদের অধিকার সুরক্ষায় কেন্দ্র আইন তৈরি করেছিল ২০১৪ সালে। পশ্চিমবঙ্গ সেই অনুসারে বিধি (রুলস) তৈরি করেছিল ২০১৮ সালে।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ০৮:০৩
Share: Save:

অতঃপর হকার পুনর্বাসনের পালা। রাজ্যের কর্তাদের রকম-সকম দেখে মনে পড়তে পারে শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই মন্তব্য, “‘লাও’ তো বটে, কিন্তু আনে কে?” যথাযথ জায়গায় হকারকে বসানোর নির্দেশ তো দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এ বার অত জায়গা খুঁজে বার করবে কে, আর হকারের ওঠা-বসা নিয়ন্ত্রণ করবেই বা কে? রাস্তায় হকার বসা চলবে না, ফুটপাতের দুই-তৃতীয়াংশ পথচারীর জন্য ছেড়ে রাখতে হবে হকারদের, এমন নিয়ম মানলে প্রচুর হকার দোকান হারাবেন। তাঁদের জায়গা হবে কোথায়? কারা জায়গা পাবেন, আর কাদের উঠে যেতে হবে? নিউ মার্কেটে তৃণমূলেরই এক হকার ইউনিয়নের নেতা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, উচ্ছেদ অভিযানের পর শতাধিক হকার বসার জায়গা পাননি। অন্যান্য অঞ্চলেও অবস্থা তথৈবচ। যে কোনও কঠিন প্রশ্ন সামনে এলে এ রাজ্যে যা হয়, এ বারও তা-ই হল— উত্তরের আশায় প্রশাসন হাত পেতে দাঁড়াল মুখ্যমন্ত্রীর দুয়ারে। কলকাতার কোন অঞ্চলে কত হকার, তাঁদের নাম-আধার-মোবাইল নম্বর, বসার জায়গার তথ্য নিয়ে, সমীক্ষার ফলাফল পেশ করা হবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তিনি যা বলবেন, তা-ই করা হবে, জানিয়েছেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। দেখেশুনে রাজ্যবাসীর মনে হতে পারে, কলকাতা পুরসভা যেন চির-নাবালক। নবান্নের চোদ্দোতলা থেকে যত ক্ষণ না তর্জন-গর্জন ভেসে আসছে, তত ক্ষণ পুলিশ-প্রশাসন যথেচ্ছ নিয়ম ভাঙবে। যেন আইন-বিধি এলেবেলে, থাকলেও মানার দরকার নেই।

রাস্তার হকারদের অধিকার সুরক্ষায় কেন্দ্র আইন তৈরি করেছিল ২০১৪ সালে। পশ্চিমবঙ্গ সেই অনুসারে বিধি (রুলস) তৈরি করেছিল ২০১৮ সালে। সেই অনুসারে হকারদের নথিভুক্তি, তাঁদের বসার জায়গা নির্ধারণ, উচ্ছেদ হলে পুনর্বাসন, ‘টাউন ভেন্ডিং কমিটি’ তৈরি করে হকারদের নির্দিষ্ট করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা— সব কিছুর বিধি-ব্যবস্থা নির্দিষ্ট রয়েছে। তৃণমূল সরকার আসার পরে একাধিক বার (২০১২ এবং ২০১৮) কলকাতায় হকার সমীক্ষা হয়েছে, হকারদের পরিচয়পত্র বিলিও হয়েছে। ২০১৯ সালে গড়িয়াহাটে একটি অগ্নিকাণ্ডের পরে প্লাস্টিকের চাদর ব্যবহার বন্ধ করে কাপড়ের চৌকো ছাতা ব্যবহার, চাকা-লাগানো স্টল করে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন স্বয়ং ফিরহাদ হাকিম। হকারদের বৈধ লাইসেন্স দেওয়া থেকে শুরু করে ফুটপাতের দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা পথচারীদের জন্য ছেড়ে রাখা, অফিসযাত্রীদের সুবিধার্থে রাত্রিকালীন হকারি চালু করা, গুরুত্বপূর্ণ ট্র্যাফিক মোড়গুলিতে ৫০ ফুট জায়গা ছেড়ে দেওয়া, এমন একগুচ্ছ নীতি প্রণয়নের কথা তখন মেয়র ঘোষণা করেছিলেন। তবে পুরসভারই নাকের ডগায় নিউ মার্কেটে অবাধে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্লাস্টিক টাঙিয়ে কেনাবেচা, রাস্তার প্রায় অর্ধেক দখল করে দোকান, বড় দোকানগুলির মুখেই হকারের স্টল, কী না চলেছে? পুর আইন অনুযায়ী কোনও বড় বাজারের সীমানার পঁয়তাল্লিশ মিটারের মধ্যে হকার বসা নিষেধ। বাস্তবে কলকাতার প্রায় সব বাজার, বাজার-সংলগ্ন এলাকা দখল করেছেন হকাররা।

কী করে এমন পাইকারি হারে বিধিভঙ্গ সম্ভব হয়েছে, তা-ও অজানা নয়। দুর্নীতির চক্রের মধ্যে চক্র চলে, অবৈধ আদায়ের গুড় ভাগ-বাঁটোয়ারা হয় নানা স্তরে। এতে শহরের অটোচালক থেকে হকার, সব পরিষেবা প্রদানকারী কেবল অর্থদণ্ডই দেন না, কার্যত ‘অপরাধী’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ হয়ে থাকেন। যা হতে পারত সুষ্ঠু নগর পরিষেবা, তা বিধিলঙ্ঘনের নানা পর্যায়ভুক্ত এক অব্যবস্থায় পরিণত হয়। এক দিকে প্রকৃত জীবিকা-প্রার্থীকে শোষণ করেন দালাল শ্রেণিভুক্ত ব্যবসায়ীরা, অপর দিকে ক্রেতা ও পথচারীর স্বাচ্ছন্দ্য লঙ্ঘিত হয়। হকারদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনে বিক্রেতা ও ক্রেতা, উভয়েরই লাভ। তবে আইনের পুনর্বাসন হলে উপরিতে টান পড়বে যাঁদের, নবান্ন তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কি না, প্রশ্ন সেখানেই।

অন্য বিষয়গুলি:

hawkers Kolkata West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE