প্রতীকী ছবি।
এক শত বৎসর পূর্বে দার্শনিক লুডউইগ ভন উইটগেনস্টাইন লিখিয়াছিলেন, সুদক্ষ বা সুনিপুণ (স্মার্ট) হওয়া এবং ভাল (গুড) হওয়া একই কথা। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ন্যায্যতা বিষয়ক আলোচনায় এই উক্তিটি স্মরণ করিয়া প্রশ্ন তুলিয়াছেন, ‘সত্যই কি দক্ষ হওয়া এবং ভাল হওয়া এক ব্যাপার?’ যে দক্ষ সে-ই ভাল? যাহার দক্ষতায় ঘাটতি আছে সে ভাল হইতে পারে না? এই সূত্রে তিনি ন্যায্যতার প্রসারে বিচারবুদ্ধির ভূমিকা সম্পর্কে যে গভীর বিশ্লেষণ করিয়াছেন, তাহা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু এই মুহূর্তে দেশের এবং রাজ্যের অতিমারি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি কেবল প্রাসঙ্গিক নহে, তাৎপর্যপূর্ণ। কোভিডের মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের কীর্তি দেখিবার পরে দক্ষতা এবং ভালত্ব, দুইটির পরীক্ষাতেই শূন্যের বেশি এক নম্বরও দেওয়া চলে না। ভান্ডারে ঈষৎ বুদ্ধি ও দক্ষতা থাকিলেও এই সরকার ভাল হইত কি না, সেই বিষয়ে ঘোর সন্দেহ আছে, কিন্তু অশুভবুদ্ধি এবং অপদার্থতার সমাহার যে কতটা ভয়ানক, তাহা ভারতবাসী মর্মে মর্মে বুঝিতেছেন।
কিন্তু রাজ্য সরকার? কোভিড সংক্রমণের প্রথম পর্বের মতোই মারির দ্বিতীয় অধ্যায়েও তাহাদের সদিচ্ছার কিছু লক্ষণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কেবল ভাল চাহিলেই ভাল করা যায় না, দক্ষতার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় বিচারবুদ্ধির, প্রয়োজন হয় বিবেচনাবোধের। সেখানে রাজ্য প্রশাসনের ফল একেবারেই আশানুরূপ নহে। সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত: পনেরো দিনের ‘ঘরবন্দি’ নীতি। শনিবার সকালে ঘোষণা করা হইল, রবিবার হইতে দোকানপাট এবং যানবাহন-সহ জনজীবনের স্বাভাবিক গতি বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হইবে। চিকিৎসক ও মারি-বিশেষজ্ঞ’সহ নাগরিক সমাজ হইতে এমন নিয়ন্ত্রণের দাবি বেশ কিছু কাল উঠিতেছিল। এপ্রিলের মধ্যভাগ হইতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর গতি যে ভাবে বাড়িয়াছে, তাহাতে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করিবার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে জরুরি ছিল। সুতরাং, রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক নহে। প্রশ্ন একটিই। এই যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তটি কেন আচমকা বলবৎ করিতে হইল? এক দিনেরও কম সময় দিয়া এমন অচলাবস্থা ঘোষণা করিলে বহু মানুষ যে আতান্তরে পড়িবেন, তাহা বুঝিবার জন্য তো কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট! প্রবীণ রাজনীতিক এবং প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় সুপরিপক্ব আমলাবৃন্দ তাহা বুঝিলেন না? তাঁহারা ভাবিলেন না যে, এমন অতর্কিতে ‘চিচিং বন্ধ’ ডাকিয়া দিলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনিয়া ঘরে রাখিবার তাগিদে পাড়ায় পাড়ায় দোকান-বাজারে সহসা ভিড় জমিবে? বকেয়া কাজ সারিবার তাড়নায় বহু মানুষ দৌড়াদৌড়ি করিবেন? সর্বোপরি, ঘরে ফিরিবার জন্য দূরবাসী মানুষের দিশাহারা তৎপরতায় যানবাহনে ও রাস্তাঘাটে অস্বাভাবিক ভিড় হইবে?
এই সমস্ত প্রতিক্রিয়াই সংক্রমণের মাত্রা বাড়াইয়া তুলিবার বড় কারণ হইয়া উঠিতে পারে। তাহার সহিত রহিয়াছে এই আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফলে অগণন মানুষের গভীর দুশ্চিন্তা এবং অশেষ দুর্ভোগের অনিবার্যতা। এবং, এই সমস্ত সঙ্কটে যাঁহাদের পড়িতে হইয়াছে, তাঁহাদের অধিকাংশই দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত বর্গের মানুষ। প্রশ্ন উঠিবে, সরকার এমন ‘নির্বোধ’ আচরণ করিল কেন? বিশেষত নূতন সরকার গড়িবার পরে মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়াছিলেন, রাজ্যে লকডাউন হইবে না, কারণ তাহাতে সাধারণ মানুষ আর্থিক সঙ্কটে পড়িবেন। সম্পূর্ণ লকডাউন হয় নাই, সত্য, কিন্তু যাহা হইয়াছে তাহার জন্য প্রস্তুতি লইতে কিছুটা সময় দিলে সাধারণ মানুষের সঙ্কট কিছুটা কম হইত। সরকার নিশ্চয়ই ইচ্ছা করিয়া তাঁহাদের বিপদে ফেলে নাই। অতএব ধরিয়া লইতেই হইবে, সরকারের বুদ্ধি, বিবেচনা ও দক্ষতার ভাঁড়ারে ঘাটতি আছে। ‘ভাল’ হইতে চাহিলে এই ঘাটতি পূরণ করা জরুরি। সদিচ্ছা জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নহে। নরকের পথ সদিচ্ছায় বাঁধানো, সেই আপ্তবাক্যও স্মরণীয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy