নরেন্দ্র মোদীর মান রাখিতে গিয়া তাঁহার দলের নেতাদের বিড়ম্বনার শেষ নাই। প্রধানমন্ত্রী নিদেনপক্ষে পঁচিশ বার বলিয়াছেন, কৃষি আইন তিনটি ‘খুব ভাল’, উহাতে কৃষকদের মঙ্গল হইবে, আজ না হউক কাল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসযোগ্যতা এমনই দাঁড়াইয়াছে যে, তিনি যত প্রশস্তি করেন, প্রতিবাদী কৃষকরা তত বেশি বাঁকিয়া বসেন। বোধ করি এই কারণেই, কৃষি আইন যে ‘খুব ভাল’ তাহা কৃষকদের বুঝাইবার দায় চাপিয়াছে তাঁহার সহকর্মীদের কাঁধে। এবং তাঁহারা উত্তরোত্তর টের পাইতেছেন, সেই দায় দুর্বহ। সম্প্রতি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলে বিজেপির একাধিক মন্ত্রী তথা সাংসদ স্থানীয় কৃষকদের সহিত কৃষি আইনের গুণপনা বুঝাইবার জন্য বৈঠক করিতে গিয়াছিলেন। বৈঠক দূরে থাকুক, তাঁহারা নেতাদের সহিত দেখাই করেন নাই, মুখের উপর জানাইয়া দিয়াছেন— আগে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিপদ ছাড়িয়া আসুন, তাহার পরে কথা হইবে। অনুরূপ বিরক্তি এবং অসহযোগের নজির কেবল ওই অঞ্চলে নহে, পঞ্জাব হরিয়ানা-সহ বিভিন্ন রাজ্যেই। এক কথায়, কৃষি আইনের প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি নেতারা নাজেহাল এবং বেসামাল।
এই পরিস্থিতির পিছনে নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার সরকারের ঔদ্ধত্য ও অসহিষ্ণুতা কতখানি দায়ী, সেই বিষয়ে নূতন করিয়া বলিবার আর কিছু নাই। কিন্তু তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে অবিশ্বাস্য নির্বুদ্ধিতাও। স্পষ্টতই, শাসকরা ভাবিয়াছিলেন, সংসদে যে ভাবে হউক কৃষি বিল অনুমোদন করাইয়া লইতে পারিলেই আর সমস্যা থাকিবে না, তাঁহারা বলিতে পারিবেন: গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মানিয়াই নূতন নীতি তৈরি হইয়াছে, আর আপত্তি চলিতে পারে না। এই ধারণার গোড়াতেই গলদ। গণতন্ত্র যেমন কেবল পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন নহে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অর্থও তেমনই নিছক সংসদে বিল পাশ করাইবার আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত হইতে পারে না। গণতন্ত্রকে ‘গভর্নমেন্ট বাই ডিসকাশন’ অর্থাৎ, আলোচনা-নির্ভর শাসন বলিবার মধ্যে এই শর্ত নিহিত থাকে যে, সেই আলোচনা হইবে আন্তরিক, অর্থপূর্ণ, ফলপ্রসূ। সরকারি নীতির প্রভাব যাঁহাদের উপর পড়িবে, নীতি নির্ধারণের সময় তাঁহাদের সহিত আলোচনা করা, মতামত জানা এবং তাঁহাদের আপত্তি শুনিয়া 0নীতি সংশোধন করা সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য। শাসকরা এই কর্তব্য পালন না করিলে গণতন্ত্র পর্যবসিত হয় সংখ্যাগুরুতন্ত্রে।
তাৎপর্যপূর্ণ যে, হরিয়ানা বা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বিভিন্ন খাপ পঞ্চায়েত-সহ কৃষকদের একটি বড় অংশ বিজেপির সমর্থক ছিলেন, কিন্তু এখন, এই কৃষি আইন প্রবর্তনের জন্য অগণতান্ত্রিক জবরদস্তির ফলে, তাঁহারাই সরকারের প্রবল বিরোধিতায় সরব এবং সংগঠিত। এমনকি, জাঠ, দলিত, মুসলিম ইত্যাদি বর্গের পারস্পরিক বিরোধও নানা এলাকায় এই প্রতিস্পর্ধী সংগঠনের দাবি মানিয়া অন্তরালে চলিয়া গিয়াছে, অন্তত সাময়িক ভাবে। দৃশ্যত, শাসকরা তাঁহাদের পরিচিত কৌশলের রাজনীতি দিয়া এই বিরোধিতাকে ‘সামলাইবার’ চেষ্টা চালাইতেছেন, উত্তরপ্রদেশে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরূপ ফলাফলের আশঙ্কায় যে চেষ্টা আরও জোরদার হইয়াছে, প্রবল প্রতাপান্বিত সঞ্জীব বালিয়াঁও কৃষকদের দ্বারস্থ হইতেছেন। কিন্তু ইহা নিছক কৌশলের বিষয় নহে। কৃষি আইনের ইতিবৃত্ত কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে, নরেন্দ্র মোদীর সংখ্যাগুরুতন্ত্রের ‘স্বাভাবিক’ পরিণাম। আজ বিপাকে পড়িয়া শাসক দলের নেতারা রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের দ্বারস্থ হইতেছেন, ‘খাপ পঞ্চায়েত’-এর কাছে গিয়া তাঁহাদের সমর্থন চাহিতেছেন, অথচ কৃষি বিলগুলি সম্পর্কে আগে তাঁহাদের সহিত আলোচনার কোনও সৎ উদ্যোগই করেন নাই। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাহা করণীয়, এই শাসকরা তাহার ঠিক বিপরীত পথের পথিক। কৃষক আন্দোলন এই মূল সত্যটিকেই দেখাইয়া দিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy